পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই মা ও মেয়ে দীর্ঘসময় অপেক্ষায় ছিলেন কাঞ্চনজঙ্ঘায় মিঠে রোদের দুরন্তপনা দেখার জন্য, কিন্তু ভাগ্য সহায় না থাকায় তখনকার মতো আশা ছাড়তে হল, তবে কেউই নিরাশ হননি। পাহাড়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন হতে সময় লাগে না তা সবার জানা, কাজেই অপেক্ষায় থাকাই যায়।
একটু বেলায় আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় হোটেলের ছাদে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা হয়েছে। দুজনে পছন্দমত টেবিলে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে প্রাতরাশ সারলেন। শালিনীর ইচ্ছায় পরপর দু-কাপ কালো কফিও হল। ভিড় কমতেই শালিনী গতকালের জের টেনে মাকে জিজ্ঞেস করল, "তারপর কি হল মা? কাল তো আর শোনা হল না।"
মিসেস মজুমদার বললেন, "এখানে নয় চল ঘরে গিয়ে বসি।"
আগের দিনের মতো দুজন দুটো সোফায় বসলেন। গতকাল যেখানে শেষ করেছিলেন ঠিক সেখান থেকে শুরু করলেন মিসেস মজুমদার, "নিতার চিঠি আসবে ভাবতে ভাবতে আমার কেমন যেন 'ফোবিয়া' হয়ে গেল। কি আছে ঐ খামে জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম। অফিসে কাজে মন দিতে পারছিলাম না। আমার বস মাইকেল একদিন বলল, 'তুমি ছুটি নাও। তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন।' বুঝতে পারলাম কি বোঝাতে চাইছে - চাকরি ছেড়ে দিলাম।"
"সে কি! চাকরি ছেড়ে দিলে?"
"আর কি-ই বা করার ছিল? আমি তো নিজে বুঝতে পারছিলাম যে একশোভাগ দিতে পারছি না। ঐ পোষ্টে আমার থাকা উচিত নয়।"
মিসেস মজুমদার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "একদিক থেকে ভাল হয়েছিল, মাথা থেকে কিছুটা ওজন কমেছিল। একদিন ছুটলাম পোস্টঅফিসে। সেখানে আগাম চিঠি দিয়ে জানিয়ে রাখলাম যদি কোন পার্সেল বা চিঠি আসে, নিজে এসে নিয়ে যাবো। মনটা কিছুটা হলেও শান্ত হল। যাই পাঠাক চিঠিটা আমার হাতে তো পড়বে।
"চাকরি ছাড়ার কথা তো কাউকে জানায়নি কাজেই রুটিন করে সকালে বেরুতাম আবার সন্ধ্যায় ফিরতাম। প্রতিদিন নিয়ম করে পোস্টঅফিস যাওয়া, এবং কোনও চিঠি আছে কিনা তার খবর নেওয়া আমার নিত্যকর্ম হয়ে দাঁড়াল।
"প্রায় এক মাস পরে একটা খাম পেলাম। লেবেলে আমার নাম, ঠিকানা টাইপ করা; পাঠিয়েছে নিতা হালদার, আমাদের কলকাতা বাড়ির ঠিকানা থেকে। ওঃ! সেই মুহূর্তের অসহায়তার অনুভূতি আমি জীবনে কোনদিন ভুলতে পারব না। মনে হচ্ছিল আমার মৃত্যু পরোয়ানা এসেছে, আমাকে এখনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। মৃত্যুর ভয় মৃত্যু থেকেও ভয়ানক। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে, বুঝতে পারছি 'ব্লাড প্রেশার' বেড়ে গেছে। আমায় চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে নিষ্ঠুর নিঃসঙ্গতা।
YOU ARE READING
চক্রব্যূহ
General FictionA story about modern-day aspirations and everyday social conflicts.