চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে নিতা ব্রেকফাস্ট-টেবিলের সামনে অপেক্ষা করছিল। তার চেহারার চমক একরাতে অনেক ঢিমে হয়ে গেছে তা লক্ষ্য করলেন মিসেস মজুমদার। চায়ের ট্রে কাছে টেনে নিয়ে নিজেই চা তৈরি করলেন। আড়চোখে দেখছিলেন নিতার পরিবর্তন; চোখেমুখে অনিশ্চয়তার ছাপ স্পষ্ট। তাঁর থেকে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে পরবর্তী আজ্ঞা পালনের উদ্দেশ্যে।
মানুষের মন কি পদার্থ দিয়ে তৈরি - কে জানে! হয়তো আজ বোধের জগতে নূতন শিশুর জন্ম হয়েছে, নিজের ভুল বুঝতে পারছে। জীবনের শুরু থেকে তো এইরকম ছিল না। জগতে সবই সদা পরিবর্তনশীল কাজেই নিতাও আজীবন অপরিবর্তিত থাকবে না তা স্বাভাবিক।
নিতার চেয়ে অনেকগুণ অন্যায় করে, ছল করে, দিনের পর দিন মানুষকে ঠকিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। নিতার পাশে তাদের রেখে মনে মনে বিচার করছিলেন মিসেস মজুমদার। সময়ের সাথে সাথে কালের করাল ছোবলে বদল এসেছে তাঁর চিন্তাধারায়। রক্তে বিষের জ্বালা অনুভব করতে পারেন, তবে জনসমক্ষে প্রকাশ করেন না।
যৌবনের প্রারম্ভে ভালোবাসার ধ্বজা হাতে জীবনের ময়দানে জয়ের জয়গানে মত্ত হয়ে যে উৎসাহ নিয়ে ছুটে বেড়াতেন, প্রৌঢ়ত্বের এলাকায় পা দিয়ে তার সিকি ভাগও অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। ভালবাসার যে সংজ্ঞা আজ থেকে কুড়ি-বাইশ বছর আগে তাঁর মনের মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করত তাতে নিঃসন্দেহে ঘুণ ধরেছে। গাছটাই শুধু দাঁড়িয়ে আছে, শিকড় নড়ে গেছে বহুদিন আগে। কে কার কথা জানে? অন্যের বিষয়ে ধারনা - সে তো নিজের মনগড়া। কে অন্বেষণ করে সঠিক সত্তার? কার সময় বা ধৈর্য আছে অনুধ্যান করার?
প্রাত্যহিক জীবনে প্রতি মুহূর্তের হিসাব খুঁটিয়ে দেখতে বসলে মন খারাপ হতে বাধ্য। হিসাবে গোলমাল থাকে বলেই শেষমেশ সুন্দরভাবে মিলে যায়। সংখ্যাগুলোকে নিয়ে যা খুশি তাই করা যায়, কারণ তাদের প্রতিবাদের ভাষা আমাদের হৃদয়ে নাড়া দেয় না। অসম্মতি প্রকাশের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত, কিন্তু মানুষের বেলায় সেই নিয়ম খাটে না। দাবী আদায়ে সে উন্মুখ—তার ভেতর প্রাণ আছে, আত্মসম্মান বোধ আছে, কাজেই সহজে বশ্যতা স্বীকার করতে চায় না। এটাই মানুষের ধর্ম, তাই নিয়েই তার গর্ব।
YOU ARE READING
চক্রব্যূহ
General FictionA story about modern-day aspirations and everyday social conflicts.