Chapter-1 | Part-3

23 1 0
                                    

ঘামে ভেজা মুড়িওয়ালার পিঠে হাত রেখে বিদায় জানাল শালিনী। ক্ষণিকের স্নিগ্ধ ও মধুর স্পর্শে মশলামুড়ি বিক্রেতা আপ্লুত। এই অভিজ্ঞতা বিরল। তাকে কেউ কোনদিন এভাবে বিদায় জানায়নি। মানুষের প্রাপ্য সম্মান থেকে চিরকাল বঞ্চিত। মুড়ির ঠোঙা দুই হাতের তালুর মাঝে নিয়ে নমস্কার জানিয়ে নমনীয় কণ্ঠে বলল, "সময় পেলে আবার আসবেন দিদি।"

শালিনী নিঃসংশয়ে জবাব দিল, "অবশ্যই আসব।"

শমিকের দৃঢ় বিশ্বাস--শালিনী এই শহর কলকাতার মানুষ হতে পারে না। শালিনীর হাঁটাচলা, কথা বলার ভঙ্গী বুঝিয়ে দেয় যে তাকে এখানে আমদানি করা হয়েছে। শমিক নিশ্চিত এই পরিবেশে শালিনী কিছুতেই বেশীদিন থাকতে পারবে না। ক্ষণকালের জন্য যেমন কিছু পাখী বেড়াতে আসে সে-ও তাই; তাদের একজন। কলকাতার পরিবেশ কখনই তার জন্য সুখকর হতে পারে না। গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটা, ধাক্কা দিয়ে চলে যাওয়া, তার পক্ষে সহনীয় হবে না।

উদ্দেশ্যহীনভাবেই হাঁটছিল দুজন, মানুষের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে। পায়ে পায়ে চলে এসেছে জিপিও-র সামনে। শালিনী মনে মনে ভাবছে--তাকে 'আপনি' সম্বোধন করা হল কেন? সেটা কি দূরত্ব বজায় রাখার জন্য, না অন্য কোন মানে আছে যা তার অজানা? ইংরাজিতে সুবিধা আছে 'তুমি' বা 'আপনির' বেড়াজাল নেই। অনেকগুলো উদাহরণ মনে মনে সাজাল শালিনী, কোথায় তুমি ব্যবহার হয় আর কোথায় আপনি? সমবয়সীদের ভেতর আপনির ব্যবহার তো মনে আসছে না, আবার বাঙলা ভাষার ওপর এত জ্ঞান নেই যে একজন বাঙালীকে তার ভাষা নিয়ে প্রশ্ন করে।

যাইহোক, নিজেকে আর প্রশ্রয় না দিয়ে শমিককে প্রশ্ন করল, "আচ্ছা তুমি আমাকে আপনি বললে কেন? এটা তো দুরের সম্বোধন তাহলে কি আমরা বন্ধু হতে পারি না?"

প্রশ্ন শুনে শমিক প্রথমে কিছুসময় হাসল। আসলে এত অবাক হয়ে গেছে যে তার উত্তর কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছিল না। একটু পরে নির্দ্বিধায় বলল, "একশোবার আমরা বন্ধু হতে পারি, বন্ধু হয়ে গেছি। আর আপনি নয়, এবার থেকে তুমি।"

হাসি ফুটল শালিনীর মুখেও। এতক্ষণ সংশয়ের যে বাণ তাকে মনে মনে খোঁচা দিচ্ছিল তার থেকে মুক্তি। মুক্তির মিঠে স্বাদ শালিনীকে আরও চনমনে করে তুলল। জলাজমিতে বা বদ্ধ জলাশয়ে সে উন্মাদনা কোথায় - যা আছে গঙ্গায়, নর্মদায়। সবেরই নমুনা আছে আমাদের মনে। সযত্নে সাজিয়ে রাখা আছে মস্তিষ্কে। শুধুমাত্র মনোযোগের অভাবে চূড়ান্ত অবহেলায় পড়ে থেকে তাতে দিনে দিনে ময়লা জমে। আনন্দের সব উপকরণ মনে মজুত থাকা সত্ত্বেও বাইরে মজা খুঁজতে গিয়ে বৃথাই হয়রান হই। অকারণে মন ভারি হয়ে যায়। প্রত্যেকটা মুহূর্তকে নিজের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয়। নিজেকে ছোট বৃত্তে বন্দী করে অন্যদের ভেবে বসি প্রতিদ্বন্দ্বী; যুদ্ধের পরিবেশে নিজেকে সৈনিক তৈরির মহড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

চক্রব্যূহWhere stories live. Discover now