কলকাতায় কলেজ-ক্যাম্পাসের রঙিন দিনগুলো প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ে যেতেই শমিক প্রবেশ করল বাস্তববাদী কর্মজগতের মহাযজ্ঞে। বাড়িতে তার আদর একরকমই ছিল, কিন্তু অফিসপাড়ার অচেনা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে সময় লাগছিল শমিকের। স্কুলে বা কলেজে সে কোনদিন ভাল ছাত্র বলে পরিচিত ছিল না। বেশীরভাগের মতো পড়াশুনার থেকে খেলাধুলা বা আড্ডায় তার আকর্ষণ ছিল বেশী। কলেজে ফাইনাল পরীক্ষার মার্কশীট যে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পদে পদে জরুরী সে সম্বন্ধে সম্যক ধারনা তার ছিল না।
যাইহোক, স্রোতস্বিনী গঙ্গায় যেমন সবই ভেসে যায়, ভাল-মন্দের বিচার সেখানে চলে না, শমিকও নিত্য-দিনের গড্ডলিকাপ্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। দৈনন্দিনতার চাকায় প্রতিনিয়ত পিসতে পিসতে অল্পদিনের ভিতরই বয়সের ভার কাকে বলে—সে সম্বন্ধে তার ধারনা ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছিল। বয়স তো সবসময় ধারাপাতের নিয়ম মেনে দিনের গুনতিতে বাড়ে না। বয়স তার খেয়ালের বশে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দেয় লতানে গাছের ডালে-ডালে; হারিয়ে যায় বহু স্মৃতিবিজড়িত প্রাচীন বটবৃক্ষের অজস্র ঝুরির মায়াজালে। বিরহবেদনার দহনজ্বালা থেকে মুক্তির স্বাদ পেতে বসন্তের আহ্বানে মনের অন্দরে মৌচাক বানিয়ে প্রেমের রসাস্বাদনের মোহে মন মজে যায়। প্রত্যেক প্রকোষ্ঠে আলাদা সংসার, মান-অভিমানের দোলাচল, নিশ্চিত মৃত্যুর নিরন্তর হাতছানি উপেক্ষা করে তারই সাথে সহবাস। মৃদু-মন্দ বাতাসে কি দারুণ সুবাস।
কাজের ফাঁকে দশ-পনেরো মিনিট ব্রেক নিয়ে শমিক রোজই অফিসের কাছে ফুটপাথের চায়ের দোকানে একবার ঢুঁ মারে। হরিদার দোকানের লিকার-চায়ের পর মৌজ করে রাজা-বাদশাহর মেজাজে সিগারেটে টান না দেওয়া অবধি সে তৃপ্তি পায় না। ছোট্ট ঝুপড়ি দোকান, কিন্তু খদ্দেরের অভাব নেই। বেশীরভাগেরই বরাদ্দ চা, আর বিস্কুট। কেউ কেউ ডিমের অমলেট আর কোয়ার্টার রুটি। দশ ফুট বাই দশ ফুটের ভিতরই হরিদার চায়ের দোকান আর ছেলে-মেয়ে-পরিবার নিয়ে নড়বড়ে সংসার; মাঝখানে বৌ-এর ছেঁড়া শাড়ি দিয়ে দু-ভাগে ভাগ করা। একে অপরের পরিপূরক। সংসার না থাকলে হরিদা হয়তো পথিক হয়ে পথেই জীবন কাটিয়ে দিত, কিন্তু তা আর হল কোথায়! বাবা-মা ছেলের উড়ু-উড়ু স্বভাব লক্ষ্য করে যৌবনের শুরুতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছিল। নিজেদের জমিজমা ছিল, গোলা ভরতি ধান ছিল, কাজেই স্বপ্ন দেখতে বাধা কোথায়!
YOU ARE READING
চক্রব্যূহ
General FictionA story about modern-day aspirations and everyday social conflicts.