পর্ব-৩

12 2 0
                                    

সবাই কাজে ব্যস্ত, এদিকে আমি টোকাইয়ের মতো এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করছি। ভাবলাম, একটু বাইরে চক্কর দিয়ে আসি। দ্রুত পা ফেলে বাইরে এলাম, আর এসেই যেই কাহিনী চোখে পড়লো, তাতে আমার সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগলো। কী ঘটছে এ বাড়িতে! বাড়ির পেছনে ময়লা ফেলার জন্য একটা বড় ডোবা আছে আমাদের। আজ সেই ডোবায় ময়লার বদলে হাবুডুবু খাচ্ছে জরিনার মা, আর সেই দৃশ্য খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে সখিনা আন্টি। আশ্চর্যের চোটে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে আমার। কী করা উচিৎ আমার! প্রায় দুমিনিট এভাবে বড় বড় চোখ করে দেখার পর চিৎকার দিয়ে সখিনা আন্টিকে বললাম,- " আন্টি আসেন, উনাকে টেনে তুলি। ময়লা পানিতে পড়ে কী অবস্থা হয়েছে উনার!" সখিনা আন্টি আমাকে এক ধমক দিয়ে বললেন,- " তুইও কী ডোবায় ডুবতে চাইতাসোস? না চাইলে চুপ কইরা খাঁড়াইয়া দেখ। " তবুও সাহস করে আবার বললাম,- " কিন্তু কেন আন্টি? উনাকে সাহায্য করতে সমস্যা কই?" সখিনা আন্টি এবার আমার দিকে ফিরে কোমড়ে দুহাত রেখে বললেন,- " এতো কষ্ট কইরা ওরে ডোবায় ফালাইসি কী টাইন্না তুলার লাইগা?" এবার আমার মুখ হা হয়ে গেলো। সখিনা আন্টি নিজেই ফেলেছেন জরিনার মাকে! - " জরিনার মা কী করেছে আন্টি? এভাবে তো উনি মারা যাবেন, তখন আপনার কী হবে ভেবেছেন?" সখিনা আন্টি বললেন,- " ও কী করসে তুই জানোস? আইজ সকালে আমি আদা রসুনের ফেসপ্যাকটা লাগাইয়া ঐ ঝোপের আড়ালে চোখ বনধ কইরা বইসা ছিলাম। হুট কইরা মনে হইলো আমার ওপর ভিজা ভিজা কিছু একটা পড়লো। গন্ধ গন্ধ লাগতাসিলো। চোখ খুইল্লা দেখি আমার পুরা শরীর ভিজা, আর পাশে একটা বালতি হাতে নিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কেলাইতাসিলো এই বুড়ি শয়তান। আমি কইলাম- আমারে গোসল করাইসো কেন? আমার ফেসপ্যাক তো শুকায় নাই। জরিনার মা আমারে কী কইসে জানোস?" এটুকু বলে সখিনা আন্টি ডোবায় পড়ে থাকা জরিনার মায়ের দিকে একবার অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,- " ও আমারে কয়- তুমি চোখ বনধ কইরা ধ্যান করো, আর আমি তোমারে গরুর হিসু দিয়া পবিত্র করি। দেখ,আমি এতো কষ্ট কইরা নিজেরে সুন্দরী বানাইসি, আর এই শয়তান বুড়ি আমার গায়ে গরুর মুত ফালাইসে। " এবার আমার মাথা ঘুরে পড়ার উপক্রম হলো। গরুর ইয়ে এনে ঢেলে দিয়েছে জরিনার মা! তাও আবার সখিনা আন্টির ওপর! এবার মনে হচ্ছে সখিনা আন্টি তো খুব কম শাস্তিই দিচ্ছে। অন্য সময়ের মতো ভয়ঙ্কর মুডে থাকলে আজ জরিনার মা কবরে থাকতো। আমি বললাম,- " আপনি উনাকে ফেললেন কীকরে?" সখিনা আন্টির মুখে এবার এক পৈশাচিক হাসি দেখা দিলো। উনি বললেন,- " প্রথমে ওর মুখটা বাইন্ধা লইসি, এরপর এক ঠেলা দিয়া ডোবায় ফালাইসি। এর লাইগাই তো চিল্লাইতাসে না। " আমার এখন খেয়াল হলো, ঠিকই তো। আমাকে দেখার পরেও জরিনার মা সাহায্য চায়নি। এই ভয়ানক মহিলার দল আর কী কী করবে! আমি চুপ করে সেখান থেকে কেটে পড়লাম। এসব মামলা তারা নিজেরাই মিটমাট করুক। ঘরে ঢুকার সাথে সাথেই হানা এসে বললো,- " তোর মুখটা এমন বিধবাদের মতো করে রাখছিস কেন? " হুট করে কোত্থেকে হবি ভাই এসে বললো,- " ওর মুখটাই ওমন। প্রথম দেখাতেই যে কেউ বলে দিতে পারবে যে ও কঠিন আকারে ছ্যাঁকা খেয়েছে। " হাঁটতে হাঁটতেই আমাকে অপমান করে চলে গেলো এই লোক। রেগে মেগে সোজা ছাদে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম, যাতে এখানে কেউ এসে বিরক্ত না করতে পারে। রেলিঙের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু স্থির হওয়ার চেষ্টা করছি। একে তো নিজের জীবন ভেলায় ভাসছে, তার ওপর এই বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান শুরু মানে সাথে করে ভয়ানক সব বিপদের আগমন। আর একটু আগে সখিনা আন্টির কর্মকাণ্ডের পর মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে আছে। আস্তে আস্তে ছাদেই হাঁটতে শুরু করলাম। ছাদের একপাশে অনেক গাছ আছে আমার। একটা বড় ড্রাম ভরে পানি রেখেছি, যাতে গাছে পানি দেয়ার জন্য আবার নিচে না নামা লাগে। ভাবলাম, সকালেই গাছে একটু পানি দেই। আস্তে আস্তে বাগানের দিকটায় যেতেই আমার বড় মেহেদী গাছটার পেছন থেকে ফিসফিস শব্দ পেয়ে দিনের আলোতেই ভয়ে দুহাত পিছিয়ে গেলাম। এ আবার কোন কাহিনী! গাছপালার আশেপাশে শুনেছি শাঁকচুন্নি আর পেত্নীদের বসবাস, আমার এখানে আবার কোনটা হানা দিলো! মনে একসাগর সাহস নিয়ে পাশের রাখা মোটা লাঠিটা হাতে নিয়ে নিলাম। ছোটকাল, বড়কালের শিখা সকল দোআ পড়তে পড়তে গাছে একটা জোরে বাড়ি দিতেই " আম্মু বাঁচাওওও" বলে একটা চিৎকার শুনতে পেলাম। কাহিনী কী! দিলাম ভূতের উদ্দেশ্যে বাড়ি, আওয়াজ মানুষের কেন! তড়াক করে গাছের পেছনে গিয়ে উঁকি দিতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। লিয়া আর জিমিন!! ওরা এখানে কী করছে! - " এই সাত সকালে তোমরা আমার গাছের পেছনে বসে ফিসফিস করছো কেন?" বললাম জিমিন ভাইয়াকে।- " কী করবো, ঘরে বসে কথা বললে তোমার সখিনা আন্টি তার স্পেশাল জুস খাইয়ে আমাকে ইন্না-লিল্লাহ করে দিবে। তাই বাধ্য হয়ে এখানেই আসতে হয়েছে। এবার আমি বললাম,- " কাহিনী কী তোমাদের? তোমরা কী এমন কথা বলো শুনি! অন্যরা তো কথা বলে, কই, সখিনা আন্টি তো কিছুই বলেনা! " লিয়া এবার আমাকে ইশারা করে চলে যেতে বললো। কাহিনী কী সেটা আমার বুঝা হয়ে গেছে, তাই জিমিন ভাইয়ার দিকে একটা গোয়েন্দা লুক দিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। এসেছিলাম ছাদে মনটাকে একটু স্থির করতে, আর এখন মনে হচ্ছে ঝটকা খেতে খেতে দুনিয়াই ছেড়ে দিতে হবে আমার। আর সেখানে দাঁড়ালাম না। বিকেলে শুরু হলো সাজগোজের পালা। সবাই হুড়োহুড়ি শুরু করেছে মেকাপ নিয়ে। আমি চুপ করে নিজের রুমে গিয়ে একটা কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পরে নিলাম, সাথে চোখে হালকা কাজল আর হালকা গোলাপী রঙের লিপস্টিক। ব্যাস! এর বেশি মেকাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। নিজে রেডি হয়ে যখন ড্রয়িংরুমে নেমে এলাম, তখন মনে হলো আমি কোন রাক্ষসপুরীতে ঢুকে পড়েছি। কারোর চেহারাই চিনতে পারছিনা। কোনটা যে কে, সেটা বুঝার কোন উপায়ই নেই। কারণ - সবার মুখ একদম সাদা, এতোটাই সাদা যে নাক, ঠোঁটের গড়নটা পর্যন্ত ধরা যাচ্ছেনা। সামনে প্যান্ট টিশার্ট পরা একজন পুরুষই হবে বোধয়, তাকে বললাম,- " আপনি একটু নিজের পরিচয় দিবেন? আমি একটু জরুরী কথা বলতাম, কিন্তু কাউকেই চিনে উঠতে পারছিনা। " লোকটা বললো,- " ওরে অ্যালোহা, আমি জিন। আরে ঐযে, হ্যান্ডসাম ছেলেটা। " আমি কপালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। ভাইয়ার বন্ধুরাও যে এসব মেকাপে সামিল হবে, এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিলো। জিন ভাইয়া আমাকে বললো,- " আমাকে খুব বেশি সুন্দর লাগছে, তাইনা?" আমি মুখে একটা শুকনো হাসি টেনে বললাম,- " হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম মাথা ঘুরে পড়ার মতো সুন্দর। " জিন ভাইয়া হাত দিয়ে চুল উল্টাতে উল্টাতে একটা ভাব নিয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি চলে এলো। দুইটা মাইক্রো গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। সব গোছগাছ করে বাড়িতে তালা দিয়ে বের হয়ে দেখি- আমি, হবি ভাই, সুজিন আর জিন ভাইয়া বাদে সবাই গাড়িতে বসে পড়েছে। মা - বাবা যেই গাড়িতে বসেছে, সেটা ছেড়েও দিয়েছে। আরেকটা গাড়িতে ভাইয়ার বন্ধুরা আর আমার বান্ধবীরা আছে। সিট খালি আছে দুইটা, মানুষ আমরা চারজন। হবি ভাই পাশের পেয়ারা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে ফোন টিপে যাচ্ছেন। আজ একটা হবি ভাইও কাঁচা হলুদ রঙের পান্জাবি আর গাঢ় নীল রঙের জিন্স পড়েছে। চুলগুলো আজ গোছানো নেই, এলোমেলো। আর তাতেই যেন তাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। পান্জাবির হাতদুটো কনুই অব্দি গুটানো, বা হাতে মোটা চেইনের ঘড়ি। বরাবরের মতোই বুকের ওপরের বোতাম দুটো খুলে আমার জন্য টোপ ফেলে শান্তিতে ফোন চালাচ্ছে হবি ভাই। চুপ করে থাকলে তাকে দেখে মনেই হয়না যে মানুষটা এমন অদ্ভুত। হুট করেই দেখলাম, আমার হাত থেকে সুজিনের হাত ছাড়িয়ে জিন ভাইয়া একটানে ওকে নিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো। সুজিন সামান্য অবাক হয়ে আছে, সেটা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর জিন ভাইয়া পেছন দিয়ে হাত এনে সুজিনের কোমড় জড়িয়ে এমন ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে যেন আমি ওদের এই কাহিনীটা দেখে বিশাল বড় ভুল করে ফেলেছি। এবার কী হবে! আমি আর হবি ভাই বসবো কোথায়! বলদের মতো দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় হবি ভাই টুক করে গাড়িতে একমাত্র ফাঁকা সিটটায় বসে আমাকে বললেন,- " তুই কী বাড়ি পাহারা দিবি? না দিলে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ।" আমি বললাম,- " গাড়িতে বসবোটা কই!" হবি ভাই আমার বা হাতে আমার কোমড়টা জড়িয়ে একটানে তার কোলে বসিয়ে দিলো। একি কাণ্ড! এতো বড় মেয়ে একটা ছেলের কোলে বসে আছি! মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলাম। হবি ভাই আমার কানের সাথে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো,- " আর একবার নড়েছিস তো সোজা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিবো। আর তোর গায়ের জোর যে খুব বেশি না,সেটা নিশ্চয়ই তোরও জানা আছে। তাই চুপচাপ বসে থাক ডাফার!" কাহিনী দেখো! কাল রাতে কী ভালো মানুষটাই না ছিলো! আর আজ! সেই একই হুমকি ধমকি! এই লোক জীবনেও সোজা করে কথা বলতে পারবেনা। হবি ভাইয়ের কোলে বসেছি তো ঠিকই, সমস্যা হচ্ছে আরেক জায়গায়। সে তার দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে ফোন চালাচ্ছে, এদিকে তার এতোটা কাছাকাছি থাকায় সেই ঘ্রাণে আমার হাত পা কাঁপতে লাগলো। আগে যা ঘটেনি, এবার সেসবই ঘটছে। কী করে সামলাবো নিজেকে!শক্ত করে শাড়ির আঁচল খামচে বসে নিজেকে বলতে লাগলাম- 'ইউ আর স্ট্রং অ্যালোহা, ইউ আর স্ট্রং! আর এই হবি ভাইয়ের দিকে তাকাসনা। নাক বন্ধ করে রাখ, শুঁকিসনা এই ঘ্রাণ! ' সুহি আপু, মানে মেয়েপক্ষের বাড়িতে পৌঁছাতেই শুরু হলো কাহিনী। মাথার ওপর গাঁদা ফুলের পাপড়ি পড়ছে, সে এক সুন্দর অনুভূতি। ঘুরে ঘুরে ওদের ডেকোরেশন দেখছি, এমন সময় দেখলাম, একটা সাদা ছেলে মুখ ভার করে বসে আছে। এটা সুগা ভাইয়া, চিনতে পেরেছি কারণ সুগা আর হবি ভাই - ই মেকাপ করেনি। বাকীরা ফুল মেকাপে আছে। আস্তে করে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,- " কী হয়েছে ভাইয়া? আপনি এভাবে বসে আছেন কেন? নামু ভাইয়া কিছু বলেছে?" সুগা ভাইয়া মুখটা গম্ভীর রেখেই বললো,- " ঐ ইনহা মেয়েটা এমন কেন?" আমি মনে মনে বললাম, শুরু হলো কাহিনী! তোমার জন্য শুভকামনা। আমি বললাম,- " কেন? কী হয়েছে?" সুগা ভাইয়া বললো,- " সবাই তো এখানে মজা করছে। আমিও করছিলাম। তো ইনহাকে সামনে পেয়ে মজা করে তিন টুকরা কমলা ওর মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। একটু পরে ও হুট করে এসে আমার মুখে আস্ত একটা কমলা ঢুকিয়ে দিয়ে বললো- আমার সাথে এসব করতে এসোনা, তাহলে গোলগোল গালগুলো কেটে ফেলবো। " বলেই সুগা ভাইয়া মুখটা বাচ্চাদের মতো করে ফেললো। আমি হাসতে হাসতে চেয়ারে বসে পড়লাম। হুমকির কী ধরন! সুগা ভাইয়ার গাল নিয়ে ইনহার এই আগ্রহ আমার বেশ ভালো লাগছে। আশেপাশে সবাইকে দেখা গেলেও আজ ইউনাকে চোখে পড়ছেনা। ও তো হলো ইবলিশের লতায়পাতায় জড়ানো বোন। আবার যে কার পিছনে লেগেছে কে জানে! এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে ওকে খুঁজতে লাগলাম। এই বাড়িতেও ছাদেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তবে এ বাড়িটা নতুন, তাই ছাদটাও একটু বড়সড়। এতো মানুষের ভীড়ে কাউকেই খুঁজে পাচ্ছিনা। হুট করেই একটা ভয়ানক মহিলার সাথে ধাক্কা খেলাম আমি। মেয়েপক্ষের মহিলারাও দেখছি সাদা ভুত সেজেছে। শুধু শুধুই আমাদের বাড়ির মানুষকে নিয়ে হাসছিলাম। মহিলাটাকে বললাম,- " নানু, আপনি কী একটা হলুদ শাড়ি পরা মেয়েকে দেখেছেন?" মহিলাটা একটা গর্জন দিয়ে বলে উঠলো,- " কী কইলি এইডা তুই! নানী! আমারে তোর নানী মনে হইলো! " হায় খোদা! না চিনতে পেরে আমি সখিনা আন্টিকে নানি বলে ফেলেছি! আজ আমি শেষ। তোতলাতে তোতলাতে বললাম,- " ধুর আন্টি! কী যে বলেন! আপনি নানী কেন হতে যাবেন, আপনাকে তো নায়িকা শাবানার মতো দেখাচ্ছে। আমি তো ঐযে দাঁড়িয়ে আছে নানু, তাকে ডেকেছিলাম। " সখিনা আন্টি আমার থুতনী ধরে একটা চুমু দিয়ে বললো,- " এই বাড়িতে একমাত্র তুই-ই আমার রূপের কদর করলি!" বলে কোমড় দুলাতে দুলাতে চলে গেলেন। আর আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আজ ধরা খেলে এখানেই আমাকে জ্যন্ত পুঁতে দিতো সখিনা আন্টি। এবার মুখে তালা দিয়ে চুপচাপ ইউনাকে খুঁজতে লাগলাম। ছাদে কোথাও ওকে খুঁজে পেলাম না। কী ভেবে যেন স্টেজের পেছন দিকটায় উঁকি দিতেই আমার চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেলো। এই ইউনাকে খুঁজতে গেলে সবসময় তেয় ভাইয়াকে ফ্রি পাই কেন! আজও তেয় ভাইয়া ইউনার হাত মুচড়ে ধরে রেখেছে, আর ইউনা " বেশ করেছি, বেশ করেছি " বলে চলেছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে তেয় ভাইয়াকে বললাম,- " কী হলো ভাইয়া? ওকে এভাবে ধরে রেখেছেন কেন?" তেয় ভাইয়া একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,- " আমার শাস্তি দেয়া শেষ হলে তোমার বান্ধবীকেই জিজ্ঞেস করে নিও!" বলেই ইউনার কানে কানে কী যেন বলে দিয়ে তেয় ভাইয়া হাসতে হাসতে চলে গেলো। আজ আর একই ভুল করলাম না, ওকে পালাতে না দিয়ে টুক করে ওর হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করলাম,- " সত্যি করে বলতো, আজ আবার কোন শয়তানি করেছিস?" ইউনা হেসে বললো, - " ছাড়তো ওসব! এই হ্যান্ডুরে কেমনে ঠিক করতে হয়, তা ইউনা জানে। " এবার আমি বললাম,- " কোনপ্রকার গাঁইগুঁই না করে সোজা সোজা কাহিনী বল, নয়তো.." ইউনা মুখটা পেঁচার মতো করে বললো,- " তোর মতো মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনাই। কথায় কথায় খালি হুমকি দিস! দেখিস, তোর সাথে জুটবেও এমন এক দজ্জাল জামাই!" ওর কথা শুনার সাথে সাথেই চোখে হবি ভাইয়ের চেহারা ভেসে উঠলো। আমি বললাম,- " ভালো হয়েছে। তুই কাহিনী বল। " ইউনা বললো,- " আরে, তেমন কিছুই না। একটু আগে আমি গিয়ে এই বাড়ির একটা হ্যান্ডু ছেলের সাথে কথা বলছিলাম। কী সুন্দর ছেলেটা পটেও যাচ্ছিলো, এমন সময় ঐ তেয় এর বাচ্চা এসে ছেলেটার কানে কানে কী যেন বললো, আর ছেলেটা আমার দিকে কেমন একটা লুক দিয়ে " ক্রেজি গার্ল" বলে চলে গেলো। আমি তেয়কে কিছু বলিনাই তখন। এর কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম, একটা মেয়ে তেয় এর পাশে বসে কী সুন্দর মধুর আলাপ করছে। আমার লাইন কেটে দিয়ে এখানে গল্প করছে! তা কী আমি হতে দিতে পারি! আস্তে করে ঐ মেয়ের চুলে চুইংগামের একমাথা লাগালাম, আর আরেকমাথা ঐ মেয়ের চেয়ারের ওপর রাখা তেয় এর হাতে লগালাম। পরে যখন মেয়েটা উঠতে গেলো,তখন ওর চুলে টান খাওয়ার পর তেয়কে গালাগাল করে গিয়েছে। বলেছে- এতোবড় ছেলে চুইংগাম খেয়ে হাতে লাগায় রাখো, খবিশ ছেলে, তোমার জন্য আমার চুল নষ্ট হলো, ব্লা ব্লা..। কিন্তু ঐ তেয় কী করে যেন বুঝে গিয়েছে যে ঐ কাজ আমিই করেছি। এরপর আমার হাত ধরে টেনে এখানে নিয়ে এসেছে। " আমি বললাম,- " ঐ মেয়ের কী দোষ ছিলো! ওর চুল খারাপ করলি কেন!" ইউনা বললো,- " জানিনা।আমার রাগ হচ্ছিলো, তাই করে দিয়েছি। " আমি সামান্য হেসে সেখান থেকে চলে এলাম। যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই হলো। এরাও কিছুদিনের মধ্যে এক হয়ে যাবে। স্টেজে পাশাপাশি বসে আছে নামু ভাইয়া আর সুহি ভাবী। বাড়ির বড়রা তাদের হলুদ লাগাচ্ছে। তবে কোনটা যে কে, সেটা বুঝতে পারছিনা। বড়দের হলুদ লাগানো শেষেই শুরু হলো হলুদ খেলা। পুরো ছাদে ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌঁড়ি করছে হলুদ নিয়ে। আমি এককোণায় চুপ করে বসে আছি। আমার চোখ শুধু হবি ভাইকেই খুঁজে চলেছে। কই গেলো লোকটা! আবার কোন চিপকি তার পেছনে ঝুলে পড়েছে নাকি কে জানে! যাই হয়ে যাক, আমি উনাকে নিয়ে এতো ভাবতে যাচ্ছি কেন! ধুর! না চাইতেও আবারো আমি ঐ হবির জগতে প্রবেশ করে ফেলছি। চেয়ার থেকে উঠে এই ভীড়ের মাঝেই হবি ভাইকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও পেলামনা। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছি, এমন সময় নিজের পায়ের সাথে লেগেই শাড়ির কুঁচিটা খুলে গেলো। সিঁড়ির পাশের জায়গাটায় গিয়ে নিচু হয়ে কুঁচি ঠিক করার চেষ্টা করছি। শাড়ি পরার অভ্যেস না থাকায় বড়সড় ঝামেলায় পড়ে গিয়েছি। হঠাৎই মনে হলো আমি শূন্যে ভাসছি। ওপরে তাকিয়ে দেখি, আমি হবি ভাইয়ের কোলে। আমাকে কোলে নিয়ে সুড়সুড় করে নিচে নেমে যাচ্ছে এই লোক।- " কী করছেন! ছাড়ুন আমাকে।" কথা শেষ হওয়ার আগেই হবি ভাই আমাকে ছেড়ে দিলো, আর আমি ঠাস করে পড়ে গেলাম। আজ বোধয় কোমড় শেষ! কিন্তু না, ব্যথা তো পাইনি! নিচে তাকিয়ে দেখলাম, একপাশে কয়েকটা পুরান কাপড় পড়ে আছে স্তুপ হয়ে, সেখানেই পড়েছি আমি। হবি ভাই বললেন,- " এবার ইচ্ছা করেই ভালো জায়গায় ফেলেছি। এরপর থেকে কোনদিন আমার কোলে উঠার পর 'ছেড়ে দিন ' কথাটা বললে কোমড় ভেঙে যেন সাত টুকরা হয়ে যায়, ওমন জায়গাতেই ফেলবো। ইডিয়ট! " বলেই আবারো আমাকে কোলে তুলে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে পড়লো হবি ভাই। কিছুক্ষণ আগে ঝটকা খাওয়ার পর কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছিনা। হবি ভাই একটা চেয়ার টেনে আমার সামনে বসে পড়লেন, আর আমি ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে কু্ঁচি ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। হবি ভাই দুবার জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। তার হাবভাব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। পায়ের ওপর পা তুলে, পাশের টেবিলে একটা হাত রেখে বসে আছেন তিনি। কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে। গলাটাও ঘামার কারণে ভিজে চকচক করছে। এতোটা সুন্দর মানুষের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতো মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কিন্তু কাহিনীটা কী! হঠাৎই হবি ভাই দাঁড়িয়ে গেলেন আর বড় বড় পা ফেলে আমাকে ঠেলে নিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেঁকিয়ে দাঁড় করালেন। ঘটনার আকস্মিকতায় একদম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হবি ভাই আমার কাঁধের ওপর দিয়ে দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে বললো,- " যেটা সামলাতে পারিসনা সেটা পরিস কেন!" একদম গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বললো হবি ভাই। আমি এবার বুঝলাম আসল কাহিনী। মিনমিনিয়ে বললাম,- " আসলে আমি.. হয়েছে কী...আসলে আমি.." সাহসই পাচ্ছি না কথা বলার। হবি ভাই বললেন,- " এসব ' আসলে, আমি' বাদে আর কিছু বলবি?" আমি এবার হাল ছেড়ে দিলাম। হবি ভাই বললেন,- " তোকে না করার পরেও তুই শাড়ি পরেছিস! এতো সাহস কোথায় পেলি তুই! " শক্ত কণ্ঠে কথাটা বলে উঠলো হবি ভাই। কোন জবাব দিতে পারলামনা। চুপ করে রইলাম। হবি ভাই এবার আরো জোরে বলে উঠলো, - " অ্যান্সার মি ড্যাম ইট!" বাপরে! দুবছরে আমাকে বকার জন্য স্পেশাল ভাবে ইংরেজিটাও শিখে এসেছে। দুমিনিট নীরবতা চললো। এরপর আবার হবি ভাই বললেন,- " তুই কী জানিস, আজও তোর কোমড়ের পাশের তিলটা দেখা যাচ্ছিলো। নিজের কোন খবর রাখিস তুই! সারাদিনই তো এর খবর, ওর খবর নিয়ে ঘুরিস। যত্তসব বেখেয়ালি মেয়েলোক!" বলেই হবি ভাই নিচু হয়ে হাঁটুগেড়ে বসে আমার কুঁচি ঠিক করে দিতে লাগলেন। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, এই লোককে তো ছাদে দেখতেই পাইনি, তাহলে আমার খবর রাখলো কীকরে!- " আমাকে খুঁজছিলি কেন?" হুট করেই হবি ভাই মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে উঠলেন। একি! উনি জেনে গেলেন কীকরে! আমি তো তার ব্যাপারে কাউকে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি! - " না তো! আমি খুঁজতে যাবো কেন আপনাকে! আমি তো...ঐ.." সময়মতো মাথাটাও আমার সাথে শত্রুতা শুরু করে। কথাটা বানাতেই পারছিনা। হবি ভাই কুঁচিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার সেই ভুবনভোলানো মুচকি হাসিটা দিয়ে বললেন,- " আগে কী মিথ্যে বলবি সেটা ভেবে নে, পরে আমাকে এসে বলিস। " ধুর! আমার ভেতর - বাহির সবটাই এই লোক এতো ভালো করে আয়ত্ত করে নিয়েছে যে কোনকিছু করেই পাড় পাইনা। তবুও সম্মান বাঁচানোর চেষ্টায় আমি কিছু একটা বলতে যাবো, তার আগেই ছাদ থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ পেয়ে একদৌঁড়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছালাম। আর গিয়েই মনে হলো, এ আবার কোন নতুন কাহিনী! দেখলাম.....


চলবে...

(i am so sorry :) একটু বিজি ছিলাম । ভুল গুলো ক্ষমা চোখে দেখবেন ।  happy reading 💜 )

Secret Admirer 2Where stories live. Discover now