চ্যাপ্টার ১২

272 17 1
                                    

এই কয় বছরে বাবার চেহারায় কী পরিবর্তন আসতে পারে আইদাদ সেটা নিয়ে ভাবছিল। হয়তো বিধ্বস্ত একটা চেহারা দেখতে পাবে, চুল দাড়ি পেকে বাবা হয়তো হঠাৎ করেই বুড়িয়ে গেছে। কে জানে।
থানায় এসে আইদাদকে আরেকজনের হাতে ছেড়ে দিয়ে অফিসার মোরশেদ নিজের কাজে বেড়িয়ে গিয়েছেন। সেখান থেকে একটা গাড়িতে করে কাশিমপুরের দিকে রওনা দিয়েছে ওরা। দুপুর পেরিয়ে কাশিমপুর পৌঁছানোর পর ওকে বেশ কয়েকটা ফর্মালিটির ধাপ পেরোতে হল। পুরো সময়টাতেই ওর সাথে আসা লোকটা পাশে ছিলেন। কোন কথা বলেননি আইদাদের সাথে। স্রেফ রোবটের মত প্রতিটা মুহূর্ত ওরপাশে থেকে সব কাগুজে কাজ করে দিচ্ছেন।
“তুমি তাহলে উনার সাথে দেখা করবে? নাকি ফিরে যাবে?”
এতদূর আসার পর আবার ফিরে যাওয়ার প্রশ্নও যে কেউ করবে এটা আইদাদ ভাবেনি। আইদাদ মাথা নাড়ে,
“ফিরে যাব না। আমি দেখা করবো।”
-“ঠিকাছে। এসো।”
আইদাদ লোকটার পিছুপিছু একটা রুমে ঢুকে। একটা ধাতব টেবিল আর দুইটা চেয়ার। একটা চেয়ারে পরিষ্কার সাদাপোশাক পরা একটা লোক বসে। শেকল বাঁধা হাত টেবিলের উপর রাখা। ওকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো লোকটা। ঝকঝকে দাঁত বের করে হেসে মাহবুব আজম নিজের ছেলেকে স্বাগত জানালেন।
আইদাদ টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ওর সাথের লোকটা বলতে লাগলো,
“আপনারা কেউ চেয়ার ছেড়ে উঠবেন না। ধরে নিবেন টেবিলের মাঝে একটা দেয়াল আছে, দয়া করে কেউ সেই দেয়াল ক্রস করবেন না”
“ওহ! ও আমার ছেলে !!”
মাহবুব আজম এত নিয়মকানুন শুনতে বিরক্তবোধ করেন। লোকটা নিয়ম কানুনের তালিক আর বাড়ায় না, আইদাদকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“আমি আমার টীমসহ বাইরে আছি।”
যেন অভয় দিচ্ছেন এইরকমই শোনায় তার কথা। আইদাদ বাবার দিকে তাকিয়েই কাঁধ কাত করে। এতক্ষণ ধরে বাবার যে জেলে পচে যাওয়া চেহারা কল্পনা করেছিল, সামনে বসে থাকা মানুষটার সাথে সেই চেহারামিলছে না।

--*--

“আমি জানতাম তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসবে। ভালো আছো?”
বাবার কথার ধরন এতটুকু পাল্টায় নি। আইদাদ মাথা নাড়লো,
“তুমি?”
“বেশ আছি! একেবারে রাজার হাল যাকে বলে!”
মাহবুব আজম প্রাণ খোলা হাসি দেন। আইদাদের ভেতরে এক ধরণের ক্ষোভ কাজ করে। এই লোকটা এত ভালো আছে এখানে! অথচ এই লোকের জন্য বাইরে কত কীই না ফেইস করেছে এতদিন, এমনকি এখনও। আইদাদ নিজের ক্ষোভ চেহারায় আসতে দেয়না। মাহবুব আজম বলতে থাকেন,
“আসলে এখানে আমাকে সবাই আমাকে বেশ ভয় পায়।”
আইদাদ ভাবে, খুনী আজমকে ভয় পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু মুখে এই কথা উচ্চারন করে না,
“শুনলাম কোন একজন লেখক নাকি তোমাকে নিয়ে বই লিখবে?”
আইদাদের বাবা দাঁত বের করে হাসেন,
-“টাইম পাস। এইভাবেযদি দুই দিন বেশি বাঁচা যায়, মন্দ কী?”
ফাঁসির রায় তবে আটকে আছে এই কারনে? মাহবুব আজম বলতে থাকেন,
“বই বিক্রির টাকা নাকি ফাউন্ডেশনে দেয়া হবে। আমি মাঝে দিয়ে চ্যারিটি বক্স হয়ে গেলাম। দায়ে পড়লে কি না করতে হয়!”
বোঝা গেল জীবনের এই অধ্যায়ের গল্প কারো সাথে শেয়ার করা মোটেও প্রীতিকর ঠেকছে তাঁর কাছে,
“বাদ দাও আমার কথা,তোমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে? তাইই বল।”
-“ এই তো, যেভাবে যাওয়ার কথা ... রিহ্যাব হাউজ থেকে এক বছরের মধ্যেই বের করে দিয়েছে... তবে এখনও সব নরমাল হয় নি।”
আইদাদ চেষ্টা করলো ওর কথা যেন অভিযোগের মত না শোনায়। তাই দ্রুত পয়েন্টে আসার সিদ্ধান্ত নিল,
“আমি আসলে একটা সাহায্যের জন্য এসেছি।”
মাহবুব আজম কেমন যেন কৌতুকের চোখে তাকান,
“কী সাহায্য?”
আইদাদ সাথে সাথে আবিস্কার করে ও আদতে কী সাহায্য চাইছে ও নিজেও নিশ্চিত না। এক মুহূর্ত ভেবে বলে,
“আমি আসলে একজন খুনী কেট্রেস করতে চাইছি ...”
আইদাদ কথাটা একটা টান দিয়ে বলে যেন অসম্পূর্ণ শোনায়। মাহবুব আজম অসম্পূর্ণ কথা সম্পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা না করে হো হো করে হেসে দেন। তাঁর চোখে রীতিমত পানি এসে যায় হাসির তোড়ে,
“তুমি এখন পুলিশের হয়ে কাজ করছো? সবকিছু নরমাল করতে, নাকি?”
নিজের অহংবোধে আঘাত হানলেও আইদাদ চুপ থাকে। মাহবুব আজম কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলেন,
“একটা কথা জানো?প্রত্যেক বাবা ছেলের মাঝে নিজের ছায়া দেখতে পায়।”
-“কে জানে, প্রত্যেক ছেলেই হয়তো নিজের বাবাকে আদর্শ করতে চায়।”
কথাটা বলেই আইদাদ চমকে উঠে। ও নিজে কখনও ছোট আজম হতে চেয়েছে বলে মনে হয়না। তবে এখন এই কথা বলার মানে কী।বিরক্ত হল নিজের উপর। এখানে আসার পর কোন কিছুই প্ল্যান মত হচ্ছে না। যথারীতি বাবা পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেছে। মাহবুব ঠোঁট টিপে হাসেন, যেন আইদাদের চিন্তা পড়ে ফেলছেন এইরকমই মনে হয় তাঁর চেহারা দেখে।
-“তুমি আমাকে সাহায্য করবে না?”
আইদাদ আবার প্রশ্ন করে। মাহবুব আজম হাসি ধরে রেখেই বলেন,
“আমি তোমার যা করতে পারি সব করেই এখানে এসেছি।”
একটু ঝুঁকে অদৃশ্য দেয়াল না ছুঁয়ে বলেন,
“বাকীটুকু তো তোমাকেইকরতে হবে।”
আইদাদ কী বলবে বুঝেনা। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে আটকে যায়। চট করে মাথা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা, অন্য একটি প্রশ্নের উত্তর দিবে?”
পারমিশানের অপেক্ষা নাকরেই আইদাদ প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“আম্মুর সাথে কী করেছো?”
আরো একবার মাহবুব আজম ঘর কাঁপিয়ে হাসেন।
-“তোমার মনে নেই?”
মনে আছে, ঘুম থেকে উঠে পুরো ঘর খুঁজেছিল। বাবা আর দাদীকে জিজ্ঞেস করছিল, বারবার। উত্তর একটাই পেয়েছিল,
“চলে গেছে।”
কোথায় কিংবা কেন- কখনো বলেনি।
মাহবুব আজম অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন,
“ তুমি তোমার প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন মনে করতে পারো? নাকি সেটাও ভুলে গেছো?”
প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন। না, তার আগেই আম্মু চলে গিয়েছিল।
“আম্মু তখন ছিল না।”
-“আই শুড’অ্যাভ ওয়েটেড ওয়ান ইয়ার মোর।”
স্বগতোক্তি করেন মাহবুব আজম। আইদাদ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে দেখে বলেই ফেলেন,
“এটা অন্তত ভুলে যাওয়ার কথা না... ”
হঠাৎ করেই আইদাদের কান গরম হয়ে যায়। ওটা শুধু একটা স্বপ্ন না। সত্যিকার অর্থেই কেউ একজন ছিল, যার রক্তে মিষ্টি ঘ্রাণ ছিল। স্বপ্নে নয় সত্যিকার অর্থেই ও নিজ হাতে টুকরো টুকরো করেছে ;নিজের মা কে।
এতক্ষণ পর হুট করেই যেন মাহবুব আজমের নজের মায়ের কথা মনে পড়ে,
“মা এখন কেমন আছেন?”
আইদাদ চোয়াল শক্ত করে উত্তর দেয়,
“এখনও বেঁচে।”
-“মনে পড়েছে তাহলে?”
আইদাদের উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি উঠে দাঁড়ান। প্রায় সাথে সাথেই রুমের ভেতর পুলিশের লোকজন ঢুকে পরে। মাহবুব আজম ফের বিরক্ত হন,
“আরে বাবাহ, এ আমার নিজের রক্ত। আমি কি ওর ক্ষতি করবো নাকি?”
আইদাদের মনে হল ওর দূষিত রক্তের অস্তিত্বের কথা বাবা ওকে শুনিয়ে দিল। দূষিত রক্তের গন্ধ নিশ্চয়ই মিষ্টি হবে না, যেমনটা মায়ের ছিল।
মাহবুব আজম কড়া পাহারায় রুমের অন্য দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যান। আইদাদ দূষিত রক্তের সম্ভাব্য গন্ধ নিয়ে চিন্তা করতে থাকে।

উত্তরাধিকার Where stories live. Discover now