চ্যাপ্টার ০৯

299 18 0
                                    

অফিসার মোরশেদ নিজের বাসায় ফিরছিলেন। একেবারে বাসার সামনে গিয়েই তাঁকে আবার গাড়ি উল্টে দিকে ঘোরাতে হল। যেই খবর এসেছে তা মোটেও সুবিধেরনা। গাড়ি থেকে নামতেই মুঠোফোনটা আরো একবার বেজে উঠলো। নাম্বার নাদেখেই লাইন কেটে দিলেন। ইন্সপেক্টর মাহফুজ তাঁকে দেখেই ছুটে এলেন,
“এইবার তিনটা আঙুল মিসিং। মাঝেরটা পাওয়া গেছে।”
অফিসার মোরশেদ মুখ খুলেও কিছু বলতে পারলেন না। একটা নিঃশ্বাস বের হল শুধু। বাম হাতের তালু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বাগানের দিকে গেলেন। লাশটি তখনও খুনী যেভাবে ফেলে গেছে সেভাবেইআছে। কালচে রক্ত জমাট বেঁধে পুডিং এর মত হয়ে আছে। অপহরন করে আনা মুখ বাঁধা, চোখদু’টো খোলা চরম বিস্ময়ে; যেন পৃথিবীর নিষ্ঠুরতায় বিস্মিত।
“যেই ফোন থেকে কল এসেছে, সেটা ভিকটিমেরই। পাশেই রেখেগেছে।”
ইন্সপেক্টর মাহফুজ জানিয়ে দেয় সব কিছুই আগের রাতে ঘটা ঘটনার সাথে মিলে যায়। এক জীবনে একই শহরে দুইটি সিরিয়াল কিলার ডীল করতে হবে সেটা অফিসার মোরশেদ স্বপ্নেও ভাবেনি।

--*--

সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফেরার আগেই বিকেলের অপরাধবোধ ধুয়ে মুছে যায়। চারিদিকে বাতাসের আগে আরেকটা লাশ পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এলাকা জুড়ে চাপা উত্তেজনা। রাস্তায় আজ মানুষজন কম। অঘোষিত হরতাল চলছে যেন।
আইদাদ এবার আর লাশ দেখতে যায় না। ক্রাইম সীন কাছে হওয়া স্বত্তেও ওদিকে পা মাড়ায় না। রামিসা ঠিক বলেছে,ও একটা স্বাভাবিক জীবন ডিজার্ভ করে। এসব করে ওর নিজেকে নির্দোষ প্রমানের দরকার নেই। যারা মনে করে বারো বছরের আইদাদ চাইলেই মাহবুব আজমকে এতগুলো খুন করা থেকেথামাতে পারতো, তাদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনা সম্ভব না।
গোসল করে ফিরে আইদাদ মোবাইলে তানভীরের দুইটা মিসডকল দেখতে পায়। নিশ্চয়ই আজ বিকেলের কথার ব্যাখ্যা চাইবে। আপনা আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
ছেলে অভিমান করেছে। আইদাদ কল দিলেও লাইন কেটে দিলো। কলিংবেলের শব্দে দ্বিতীয়বার কল দিতে দিতে দরজা খুলতে গেল।
“কল কেটে দিচ্ছি তাও কল দেস ক্যান?”
দরজা খোলা মাত্র তানভীরের বিরক্তিমাখা ঝাড়ি শুনতে হল।
“গোসল করতেসিলাম, তাই ধরতে পারি নাই।”
সোফায় আসন করে বসা দাদীকে তানভীর সালাম দিল। পাছে দাদী খোশ গল্প শুরু করে দেয় তাই আইদাদ তানভীরকে রীতিমত ধাক্কা দিইয়ে নিজের রুমে নিয়ে আসলো।
“আজকের ঘটনা শুনেছিস?”
তানভীর কম্প্যুটারের সামনে বসে জিজ্ঞেস করল।
“না।”
একটা ওয়েব অ্যাড্রেস অর্ধেক টাইপ করে তানভীর ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালো,
“সিরিয়াসলি? আমি ভেবেছি তুই রামিসার সামনে এমনেই বলেছিস।”
“আমি গত রাতেই এগুলা ভেবেছি। রামিসা ভুল বলে নাই।”
“তোর তো নিজেকে প্রমানের দরকার নাই। আমিও তো সেটাই বলছি। কিন্তু তুই যেভাবে এই কেইসে হেল্প করতে পারবি সেভাবে বাংলাদেশের আর কোন গোয়েন্দা পারবে?”
তানভীরের কথা অমূলক নয়। একজন মানুষ যেই বয়সে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলা শেখা সেই বয়স থেকেই আইদাদ এই ব্যাপারে দীক্ষা লাভ করেছে।
“মোরশেদ আংকেল সাফ বলে দিয়েছে এরপর আমাকে আর সাপোর্ট দিবে না। ইভেন ...”
প্রথম দিন ইন্ডাইরেক্টলি সন্দেহের লিস্টে ওকেও রেখেছে মোরশেদ আংকেল এটাও বলেছিল। কথাটা তানভীরকে না বলে ঘুরিয়ে নেয়,
“ ... সাহায্য করতে গিয়ে ফাঁসার তো দরকার নাই। আমি হেল্প করতে চেয়েছি। উনারা হেল্প নিতে চায়নি। আগ বাড়িয়ে কী দরকার?”
তানভীর কৌতুকেরদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে। ওর চেয়ে কে ভালো জানে এই সব কথা অবান্তর। আইদাদ চুপ মেরেযায়।
“নতুন পোস্ট দিয়েছে!”
আইদাদ কম্প্যুটার স্ক্রীনে তাকায়।
www.killerazam.com পেজ ওপেন করে তানভীর বসে। মাহবুব আজম গ্রেফতারের কিছুদিনপর কয়েকজন উৎসাহী মানুষ একটা ওয়েবসাইট খুলে তার নামে। প্রথম প্রথম ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সদস্যরা নিজেরা বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে নিজেরা একটা কম্যুনিটি গড়ে তুলে খুনীআজমের শাস্তি ত্বরান্বিত করতে। পরবর্তীতে একটা ফাউন্ডেশন ও হয়। স্বাভাবিকভাবেই ফাউন্ডেশনটা মাহবুব আজমের নামে হয়নি।
এখন কিছুদিন পর পর মাহবুব আজমের একেকটা খুনের গল্প পোস্ট দেয়া হয়। ডিসকাশন চলে একেকটা ঘটনার উপর।তানভীর খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে এসব। আইদাদ আগে থেকেই জানে একশ চৌদ্দ খুনের বৃত্তান্ত।তাই কখনও আগ্রহী হয় নি।
তানভীর সময় করে পুরো পোস্ট পড়ে মনিটর থেকে চোখ সরায়।
“ঠিকাসে। তুই পুলিশকে হেল্প করিস না। কিন্তু আমাকে এইটা বল, প্রথম মহিলার দুইটা আঙুল নিলেও এইবাবেরটার তিনটা আঙুল কাটসে কেন?”
বোঝাই যাচ্ছে, আইদাদ বাসার সামনে নামিয়ে দিলেও তানভীর এতক্ষণ ক্রাইম স্পটেই ছিল। আর যেভাবে হউক কিছু ইনফো কালেক্ট করেই এসেছে।
“তিনটা কাটুক আর পুরাহাত কাটুক, তোর কী?”
আইদাদ এড়িয়ে যেতে চায়।
“একটা খুনী ঘুরে বেড়াইতেসে। যেটাকে তুই চাইলেই ধরে ফেলতে পারবি। কিন্তু তোর বাপের কারনে তুই কাজটা করতে পারবি না। আমার তো সেইরকম কোন সমস্যা নাই।”
তানভীর প্রচুর বকে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে, গোয়েন্দাগিরি করার জন্য এইভাবে ডেসপারেট হবে আইদাদ কখনোই ভাবেনি। ও কী সত্যি সত্যিই পুরো ব্যাপারটা কোন থ্রিলার টিভি সিরিজের সাথে গুলিয়ে ফেলছে?
“খুব বড় জনদরদী হইসোস, না?”
আইদাদ চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে। তানভীর নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত পিছনে রেখে রুমের মধ্যে পায়চারী করতে করতে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
“একজন বলল, পুলিশ একটা আঙুল পেয়েছে। দ্যাট মীনস, শয়তান ব্যাটা ইচ্ছে করে রেখে গেছে আগের আঙুলটাও...”
“কেন ত্যানা পেঁচাইতিসিস?”
তানভীর উত্তর দেয় না। নিজের নাটুকে ভঙ্গি চালু রাখে। সিনেমার মত যেন জোরে জোরে চিন্তা করতে থাকে,
“এইবারের মহিলাটাকে ওইখানেই খুন করা হইসে। আমি গিয়ে লাশ দেখতে পারিনাই। তবে জায়গাটাতে রক্ত ছিল।”
“এলাকার মহিলা?”
“দেখি নাই তো। কেউ কেউ বলতেসে কোন একটা হোটেলে নাকী মেইডের কাজ করে।”
“অ। ভালো।”
“আঙুলের ব্যাপারটা কী?তোর কী মনে হয়?”
তানভীরের অভিপ্রায় আইদাদ এতক্ষণে ধরতে পারে। ইচ্ছে করেই আইদাদকে নিজের জানা ইনফোগুলো বলছে। এতসবশুনলে আইদাদ নিজেকে আর আটকাতে পারবেনা। ক্ষেপতে গিয়ে ক্ষেপে না, শান্ত ভঙ্গিতেবলে,
“দোস্ত তুই এইসবে জড়াইস না। আমাকে সন্দেহ করা গেলে তোকেও সন্দেহ করা উচিৎ।”
তানভীর পায়চারী থামিয়ে ভ্রু কুঁচকায়।
“দ্যাখ,তোর বেস্টফ্রেন্ড একজন লোকাল সাইকোপ্যাথ। তুই নিজেই বল, তোকে নরমাল ভাবা কি খুব নরমাল শোনায়?”
আইদাদ যেটা চেয়েছিল ঠিক সেটাই হল। তানভীরের চোয়াল শক্ত হয়েগেল,
“পেটে রেখে কথা বলবিনা। আমার সাথে স্পষ্ট কথা বলবি।”
“আর সবার কাছে তুই নিজেও খুব একটা নরমাল মানুষ না। তাই, এইগুলা তোর কাছে নরমাল লাগতে পারে, আর সবার কাছে না।”
কথাটা বলা মাত্র আইদাদের মনে হল একটু বেশিই বলে ফেলেছে ও। তানভীর কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। বোধহয় মনেমনে কথা সাজালো। ওর রক্তশূন্যতায় ভোগা ফর্সা চেহারা গোলাপী হয়ে গেছে। যেন বাচ্চা একটা ছেলের জোর করে কান্না চেপে রাখতে কষ্ট হচ্ছে।
“এখন তুই আমাকে আর সবার কথা শুনাচ্ছিস!?”
কথাটা প্রশ্নের মত শোনালো যদিও কোন প্রশ্ন ছিল না। আইদাদ তাই চুপ রইলো। হঠাৎ করেই ঘরের পরিবেশ কেমন যেন গুমোট হয়ে গেছে।
“আমি গেলাম। ভালো থাক।”
তানভীর শুকনা গলায় বিদায় নিল। অভিমানী তানভীরের কন্ঠ এটা না। আইদাদ জানে, এই তানভীর থেকে আগের তানভীর বের করে আনা কষ্টের হয়ে যাবে।

উত্তরাধিকার Where stories live. Discover now