পর্ব ৬

7 1 0
                                    

পরীর স্কুল থেকে বের হয়ে আমি সোজা বাসার দিকে র‌ওনা হলাম কিন্তু বাসায় ঢুকলাম না। চারপাশে গাড়ি ঘুরালাম কিছুক্ষণ এরপর নেমে দাঁড়ালাম। কয়েকটা দোকানে ঢোকার বাহানা করে এলাকা দেখা শুরু করলাম। কয়েকটা মুদি দোকান, একটা গাড়ির শোরুম আর বেশ কয়েকটা ফাস্ট ফুডের দোকান ছাড়া তেমন কিছু নেই আশে পাশে আর। তবে বাড়ির একদম কাছাকাছি একটাই মাত্র বাড়ি আছে আমাদের মত‌ই আর বাকি সব দূরে দূরে। সেই বাড়িটার মধ্যে মানুষের আনাগোনা তেমন দেখলাম না এইটুকু সময়ের মধ্যে। হাতের জিনিসপত্র নিয়ে যখন বাড়িতে ঢুকছি তখন সেই বাড়ি থেকে একজনকে বের হয়ে আসতে দেখলাম। লম্বা, স্বাস্থবান, টি শার্ট আর জিন্স সাথে বুটস। মাথার চুলগুলো সে বারবার হাতরাচ্ছে আর দরজা লাগাচ্ছে। পেছনে ঘুরতেই আমার সাথে তার চোখাচোখি হয় আর আমি হুড়মুড়িয়ে বাড়িতে ঢুকে যাই। লোকটা, না ছেলেটা, বাড়িতে কি একা থাকে? একা থাকলে কি করে? দেখি না কেন? কি কাজ করে সে? আর এত বড় বাড়িতে একা কেন থাকবে? তবে যদি সাথে পরিবার থাকে তাহলে তারা কোথায়? একজন না একজনকে তো চোখে পরার কথা।

"এ কি? তুমি এসব কি নিয়ে এসেছো?"
টুকটাক বাজার, বাচ্চাদের জন্য চিপস-চকলেট, হালকা পাতলা নাস্তা যা নিয়ে এসেছি সব চাচীর হাতে দিলাম। যে যাই বলুক, বাইরে থেকে আসলে মাথার উপর বসে বসে খেলে কথা একটা সময় শুনতেই হয়। তার চেয়ে ভালো কিছু একটা করি, সবাই ভালো থাকুক, আমিও ভালো থাকি।
"এই তো ভাবি, তেমন কিছু না। বাবা কোথায়?"
"তোর বাবা বাইরে গেছে বিল দিয়ে আসার জন্য।"
রান্নাঘর থেকে মাথা বের করে মা বললো। আমি একটা চিপসের প্যাকেট খুলে, একটা চিপস মুখে দিয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।
"কিসের বিল?"
"ওইতো, বিদ্যুৎ গ্যাস ইন্টারনেট এই জাতীয় সব। বাজার‌ও লাগবে কিছু।"
"মা, আমাকে এখন এসব বিলের কাগজ দিয়ে দিও। আমি পূরণ করে দিবো আর বাজার আমি নিয়ে এসেছি কিছু। বাবাকে ফোন করে বলে দাও কাজ শেষ হলে চলে আসতে।"
ঠিক তখন‌ই তনিমা, আমার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে, রান্নাঘরে দৌঁড়ে ঢুকলো আর আমাকে দেখেই কেমন যেন স্থির হয়ে গেল। একটা চকলেট বের করে তার হাতে দিলাম। বয়স তার চার ছুঁয়েছে মাত্র আর অনেক পাকনা। তার সাথে কথায় পারা যায় না।
"এটা আমার জন্য?"
"হ্যা, তোমার জন্য। এইটা ভালো লাগে না? কোনটা ভালো লাগে আমাকে ব‌ইলো, আমি সেটা নিয়ে আসবো।"
গাল টেনে আমি বললাম। বাচ্চাদের সাথে আগে থেকেই আমার কথা বলতে খুব ভালো লাগে।
"কিন্তু মা বলেছে, তুমি শুধু পরীকে ভালোবাসো তাই তোমার সাথে যেন আমি বেশি কথা না বলি। দূরে দূরে থাকি আর কিছু দিলেও যেন না নেই।"
আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে ভাবির দিকে তাকালাম। পরীর জায়গা আমার মনে বিশেষ হলেও আমি তাদের সবার আপন। পরী আমার নিজের ভাতিজী আর তনিমা আমার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে বলে আমি তাকে অবহেলা করবো এমন তো কোন কথা নেই।
আমি তনিমার দিকে তাকিয়ে তাকে টেনে চেয়ারে বসালাম। তনিমার গালে আর কপালে আদর করে দিয়ে বললাম,
"পরী যেমন আমার মা হয়, তুমিও হ‌ও। তোমার মা তোমাকে কি বলেছে সেসব ভুলে যাও, আমি তোমাদের সবাইকে এক চোখে দেখি। পরী আমার জন্য যা, তুমি, শিখা, রতন সবাই আমার জন্য তা। এটা সবসময় মনে রাখবে। এখন ফুঁই চলে এসেছি, কারো কথা শুনতে হবে না। ঠিক আছে?"
তনিমা গাল ভরে হেসে আমার হাত থেকে চকলেট নিয়ে চলে গেল। এক কামড় দিয়ে পিছে ঘুরে আবার বললো,
"ফুঁই, পরেরবার আমার জন্য ডেয়রি মিল্ক আর বাকিদের সবার জন্য কিটক্যাট নিয়ে এসো। আমরা ওটাই পছন্দ করি।"
আমি হেসে সম্মতি জানিয়ে মা আর ভাবির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। আমার রাগ কেমন তারা সবাই জানে তাই চুপসে আছে কিন্তু আমি এসেই কারো উপর রাগ দেখাতে চাই না তাই সোজাসোজি একটা কথা বললাম।
"তোমরা এতদিন কে কিভাবে ছিলে আমি জানি না, পরীকে কিভাবে রেখেছো আমি পরোয়া করি না আর বাড়ির কে আমার আর পরীর সম্পর্ক নিয়ে কি ভাবলো সেসব‌ও আমি তোয়াক্কা করি না। কিন্তু একটা কথা আমি বলে দিতে চাই, আমার জন্য সবাই সমান তাই দয়া করে পরী বা আমার বিপরীতে কাউকে ক্ষেপিও না। পরিণতি ভালো হবে না।"
এই বলে আমি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দুমদাম নিজের ঘরে চলে গেলাম। একে তো পরীকে প্রায় অবহেলার মত‌ই বড় করেছে নাহলে পরী এতটা একা অনুভব করতো না। বাবা মা আর কত‌ই বা করতো পরীর জন্য, বাকিদের তো একটু এগিয়ে আসাই লাগে। তার উপরে বাড়ির বাকি বাচ্চাদের‌ও আমার বিপরীতে খেপিয়ে দিচ্ছে। পরীর জঘন্নতম শৈশবের জন্য তাকে অন্য চোখে দেখার মানে কি? আর কোন সাহসে তারা এখন‌ও সন্দেহ করছে যে পরী এই বাড়ির কেউ না? ওইবার কি সব পরিষ্কার করে দেই নি আমি? নাহ, এভাবে চলতে পারে না। বাবার সাথে কথা বলতে হবে আমাকে আর আমার কাজ শুরু করে দিতে হবে।

সুহাসিনীWhere stories live. Discover now