পর্ব ২

27 4 2
                                    

প্রায় আরো এক ঘণ্টার মত লেগে গেল বাড়ি পৌঁছাতে। রাস্তার জ্যাম তো ছিল‌ই সেই সাথে মা কিসব জিনিস কিনতে পাঠিয়েছিল, অদ্ভূত অদ্ভূত সব, ওইগুলো পেতে আরো সময় লেগে যায়। তাড়াহুড়ো করে বাকি সব গাড়িতে রাখার কিছুক্ষণ পর‌ই রাস্তা খালি হলো আর শানুকে নিয়ে ঝটপট বাড়ির দিকে এগোলাম। আমার ভাবতেই অবাক লাগছে আজকে এত বছর পরে প্রথম এই শহরে এসেই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা এরকম হয়েছে। পৌঁছাতে লাগলো এতটা সময় তার উপরে বাসার জন্য বাজার করে নিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে যেন আমি কত যুগ ধরে এখানেই থাকি আর আজকে বাড়ির প্রয়োজনে বের হয়ে আটকে গিয়েছিলাম। জীবনটা কি অদ্ভূত!

ঢাকা শহরে ছোটাখাটো দোতলা বাড়ি আমাদের একটা। পুরাতন কোন মহল্লা বা ঐতিহাসিক কোন এলাকায় না বাড়িটা। গাজীপুরের ভেতরেই আমাদের ছোট্ট সুখের সংসার। অনেক অনেক বাড়ির মাঝে আমাদের বাড়িও একটি। বাইরের দিকে হালকা গোলাপী রঙ করা বাড়িটা আর চারপাশে গাছ-গাছালী দিয়ে ভরা। সবুজের মাঝে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নের এই মঞ্জিল। কয়েক গজ ছেড়ে ছেড়ে পাশের দালানগুলো এবং দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোন একটা বড়লোকদের সোসাইটি এটা। প্রতিটা বাড়ির‌ই নিজস্ব খোলামেলা জায়গা আছে চারপাশে, গাছপালা আর দূরে কোথাও ছোট একটা পুকুরের মত কিছু দেখা যাচ্ছে। এসব জায়গা আগে পুকুর‌ই ছিল আমার জানা মতে। হঠাৎ করেই এই জায়গাটা খুব কম দামে বিক্রি হ‌ওয়া শুরু করলো আর বাবাও সুযোগ বুঝে বেশ বড় একটা জায়গা কিনে নিল। তবে কখন‌ও আসা হয়নি আমার। অবাক হলেও সত্য যে আজকেই প্রথম আমি আমার বাড়িতে এসেছি আর এই প্রথম সবার মুখে শোনা স্বপ্নের মত করে বানানো বাড়িটা নিজের চোখে দেখছি। বাবার কত স্বপ্ন ছিল এমন একটা বাড়ি করার আর ভাইয়া তো সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত ছিল যখন শুনেছে ঢাকায় বাবা বাড়ির কাজ ধরেছে। সে এক বড় গল্প!

গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ শুধু দাঁড়িয়ে থাকলাম। কোন কথা বলা বা শোনার মত পরিস্থিতি ছিল না। মুগ্ধ হয়ে শুধু আমার সামনে থাকা ভবনটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দুই মঞ্জিলের বাড়ি, ত্রীভূজ আকারে। সামনে কিছু বারান্দা ঝুলে আছে আর পাশে ছোট একটা ছাদ যেখানে কিছু মানুষ হয়তো কিছু একটাতে বসে আছে। থেকে থেকে কিছু জায়গায় অন্যান্য রং দিয়ে বিভিন্ন আকৃতি আঁকা হয়েছে। সত্যিই, বাবার আর ভাইয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো কিন্তু ভাইয়া...
"আপা, চলেন। ভেতরে চলেন।"
শানুর কথায় ঘোর থেকে বের হলাম আর পেছনে তাকালাম। ছেলেটা কি বুঝলো জানি না, তবে গাড়ি থেকে সব জিনিস বের করতে শুরু করলো। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রথমে থেমে যায় এরপর কিছু না বললে নিজের কাজ চালিয়ে যায়। বেচারাকে আর কিছু বললাম না। আমার গাড়ি খেয়ে ফেলবে না সে নিশ্চয়। এরপর‌ও আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার কাছে এসে বললো,
"আপা, লিপিকা আপনের গাড়ি গ্যারেজে নিয়ে যাইবো। আপনি এখন নিশ্চিন্তে ভেতরে চলেন আমার সাথে। সবাই আপনার জন্য কত অপেক্ষা করতাছে!"
শানু তার মনের খুশিতে কথা বলেই চললো। কিছু কানে ঢুকলো আর কিছু ঢুকলো না। আমার ভাইয়ের এই আরেকটা স্মৃতি যা দেখে পুরনো অনেক কথা মনে পরছে আজকে। বাড়ি বানানোর সময় পুরোটা ক্ষণ ভাইয়া ঢাকায় ছিল। আমার সাথে তার শেষ দেখাটাও হতে পারে নি তবে আমি প্রতি মুহূর্তের খবর জানতাম। আজকে এই আঙ্গিনায় এসে, এই বাড়ির দুয়ারে পৌঁছে কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে ওইতো ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে আমাকে কোলে তুলার জন্য, এখন‌ই বুঝি বলবে "বুড়ি তুই কত্ত বড় হয়েছিস রে! আর এত মোটা হলি কবে থেকে?", আর এরপর আমি তার সব কথা অন্য কান দিয়ে বের করে জোরে দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ার কোলে উঠে পরতাম। আজ‌ও বুঝি ভাইয়া সেভাবেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল!

সুহাসিনীWhere stories live. Discover now