পর্ব ৫০

1.5K 39 24
                                    

সেই রাত একটার সময় ঘুম ভেঙে গিয়েছে | এরপর আর একটুও ঘুম হয়নি | তখন তিনটা কি সাড়ে তিনটা হবে বোধহয় | একটু তন্দ্রামত এসেছিলো কিন্তু তাও হুট করেই ছুটে গেল | অনেকক্ষন বিছানায় এপাশওপাশ করে অবশেষে উঠে পড়লেন | জানালায় তাকিয়ে আকাশের দিকে দেখলেন | ভোর হতে দেরি আছে | এখনও সুবহেসাদিকও হয়নি |
মনজুর উঠে বাথরুমে গিয়ে ওযু করে এলেন | আজকে দিনটা কেমন যাবে কে জানে ! গতকাল তো নানা ঝামেলায় দিন কেটেছে | বেশ কয়েকদিন হল নওয়াজ সাহেবের সাথে তিনি দেখাসাক্ষাৎ করেন না | সেই মিলাদের দিনের পর আরেকদিন দেখা হয়েছিল কিন্তু সেদিন তিনি তার পুরোনো বন্ধু দেলোয়ারের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন | বহুদিন পর সেদিন নিউমার্কেটের বাজারে দেলোয়ারের দেখা পেয়েছিলেন | দেলোয়ার দাওয়াত দিয়েছিল তাই তাড়াহুড়া করেই যাচ্ছিলেন আর নওয়াজ সাহেবের ডাকে না দাঁড়িয়েই চলে গেলেন |
গতরাতে আইলান যে রাগ হয়েছিল এর কোন মানেই তিনি রাতে খুঁজে পাননি | কি জানি হল কি ছেলের ! এখনকার ছেলেমেয়েরা অদ্ভুত | এদের ভালো চাইলেও এরা বোঝেনা | আচ্ছা তিনি কি অন্যায় করেছেন কোন ছেলেমেয়েদের ভালো চেয়ে ? তিনি যদি না করতেন এরকম তবে কি ওরা মানুষ হত ? অবশ্যই না ! অথচ কি অভিযোগ এদের তার বিরুদ্ধে আর তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে | তিনি তাই করেছেন যা নিয়ম এখনকার | আর এখনকার কেন ? এই তো সবসময় হয় ! যেটা সবাই করে, যা প্রায় মানুষকেই করতে দেখেছেন তিনি করেছেন | তিনি তাই করে অন্যায় তো কোন করেননি | তিনি তো তার আশেপাশে তাই দেখেছেন |
এইতো তার বন্ধু দেলোয়ারই তো | দেলোয়ারের তিনটা ছেলেমেয়ে | এক ছেলে আর দুই মেয়ে | ছেলে ইন্টার পাশ করার পর যখন সে কোন পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে টিকলো না তখন সে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইল |
দেলোয়ার ছেলের এই শখ দেখে তাকে স্যান্ডেল দিয়ে পেটালো আর বলল, "শখ কত হারামজাদার দ্যাখো ! ইস খায়েস ! আমি গায়ের রক্ত পানি করে এদের খাওয়াচ্ছি পড়াচ্ছি আর এনারা আবদার নিয়ে আসে একেকজন একেকটা ! প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়বে ! নবাবজাদা ! কয় পয়সা কামাই করিস তুই এত্ত খায়েস তোর ! কুত্তারবাচ্চা যোগ্যতা হলনা একটা ভালো জায়গায় চান্স পাবার আর দাঁতকেলিয়ে আমাকে এসে বলে কিনা পেরাইভেটে পড়ব ! তোর কোন হদাগুষ্ঠির ঠাকুরে তোর জন্য গুপ্তধন রেখে গেছে হ্যা তুই পেরাইভেটে পড়বি ? কয়টাকা কামাস যে যে এসব আবদার আনিস ? সিধায় সিধায় কোন কলেজের ফরম তুলে অনার্স ভত্তি হ জানোয়ার কোথাকার ! আমি দিনরাত এক করে খেটে একে পেরাইভেটে পড়াবো ! বড়লোকির আর জায়গা নেই !"
দেলোয়ারের ছেলে একটা কলেজে ইংরেজিতে অনার্স ভর্তি হল | এসএসসি আর এইচএসসি-তে ভালো রেজাল্ট ছিল তাই তার খুব শখ ছিল রসায়নে পড়ার কিন্তু বাপের টিটকিরির সামনে সে এই ইচ্ছা ত্যাগ করে ইংরেজিতে ভর্তি হল | ভর্তির ছয়মাস পর দেলোয়ার ছেলেকে হাতখরচ দেয়া প্রায় বন্ধ করে দিলো | দশটা বিশটা টাকার জন্য সে বাপমায়ের কাছে আকুতিবিকুতি করে ফিরত | দেলোয়ারের এক কথা | সব ছেলেমেয়ে টিউশনি করে খরচ চালায়, তুইও চালাবি | সে বাধ্য হয়ে টিউশনি ধরল | ছেলে টিউশনি শুরু করার বছরখানেক পরেই তার মাবাবা দুজনেই তাকে বলল যে এখন থেকে ঘরে খরচ দিতে হবে তাকে | সে তাই দিত | অনার্স শেষ হবার মাস কয়েক আগে থেকেই দেলোয়ার শুধুই এককথা বলত ''চাকরি বাকরি দ্যাখ এবার ! আমার তো বয়স হচ্ছে নাকি ? আমি কতদিন তোকে পালব !"
ছেলেটা অনার্স শেষ করে একটা ছোট চাকরি পেল কিন্তু দেলোয়ার এতে একদম সন্তুষ্ট না ! সে দিনরাত ছেলে কথা শুনিয়ে নাজেহাল করে ফেলল | ছেলে মাস্টার্স করে এমবিএ করতে চায় শুনে দেলোয়ার বলল, "তোর মামাদেরকে আর তোর নানীকে বল তোকে পড়াতে ! এই জানোয়ার আমি টাকার গাছ দিয়েছি রে ! এতদিন পড়ালাম এখন বুড়ো আধদামড়া ছেলে আবার কিসে ভর্তি হবে ! লজ্জা করেনা তোর ! বুড়ো বয়সে আমি কামাই করছি আর তুই এখনও কিছুই জোগাড় করতে পারিসনি !"
ছেলের মাস্টার্স শেষ হতেই দেলোয়ার যেন কেয়ামত শুরু করল ! তার একটাই কথা, পড়াশুনা শেষ এখন ঘরে কেন বসে থাকবে ! পড়া শেষ এখন ভালো চাকরি করবে | আরে পাচ্ছেনা আবার কি কথা ? এত মানুষে পায় আর ও পায়না কেন ? নিশ্চই যোগ্যতা নেই ! কিন্তু চেষ্টা তো করে যেতে হবে তা যত কষ্টই হোক |
যাক ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল যে দেড় বছরের মাথায় একটা ব্যাংকে চাকরি হয়ে গেল তার কিন্তু এতেও দেলোয়ার ক্ষুণ্ন কারন বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি হয়েছে | সরকারি ব্যাংকে কেন হলোনা ? এখানেও ছেলেকে রাতদিন তাগাদা দিতে লাগল সে | "চেষ্টা কর সরকারি ব্যাংকে যাবার | এসব পেরাইভেট ব্যাংকের চাকরির দাম আছে নাকি কোন !" এই একমাত্র কথা দেলোয়ারের |
এরপর ছেলে বিয়ে করতে চাইলে দেলোয়ারের স্ত্রী তৎক্ষনাৎ বলল "আগে ছোটবোনের বিয়ে দে | এরপর নিজের ভাবনা কর |" দেলোয়ার তার মেয়ের বিয়ে দিয়েছে একটা থানা মৎস কর্মকর্তার সাথে | ছেলের বয়স মেয়ের চেয়ে কিছুটা বেশি ( মেয়ের বাইশ আর ছেলের উনচল্লিশ ) | আর ছেলের একটু খুঁত আছে | মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে একটা পা একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে | কিন্তু তাতে কি ! এসব কোন সমস্যা নাকি ? ছেলে বিসিএস ক্যাডার ! এতবড় যোগ্যতার কাছে এসব খুঁটিনাটি ত্রুটি তুচ্ছ | দেলোয়ারের ছেলে তাও বলতে গিয়েছিল যে ছেলে একটু বেশিই বয়স্ক হয়ে যায় কিন্তু দেলোয়ারের চিৎকারের কাছে একথা টেকেনি | তার সাফ কথা ! ছেলে ফাস্ট ক্লাস অফিসার ! এত যোগ্য ছেলে আর পাওয়া যাবেনা | মেয়ে রাজিনা শুনে মেয়ের মা এমন চড়থাপ্পড় বসলো কয়েকটা যে মেয়ের মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে গেল | দেলোয়ার বিয়ের দিন দন্তবিকশিত করে বলল, "আরে বাপ মা সন্তানদের ক্ষতি কি চায় কখনও ! কোনদিন না ! তারা যেটা ভালো যেটা ঠিক সেটাই সন্তানের জন্য দেখে ঠিক করে |"
দেলোয়ারের মেয়ে ছাত্রী ভালো ছিল তাই বিয়ের পরও পড়াশুনা করে গেল সে | তার স্বামী তাকে পড়ালো আর চাকরির সুযোগ করে দিল | কিন্তু এটা সে করল তার কারন এই নয় যে সে নারীস্বাধীনতায় বিশ্বাসী, বরং কারন হল এই যে সে আর স্ত্রীর ভরনপোষন করতে ইচ্ছুক না | স্ত্রী চাকরি করে নিজের খরচ নিজে চালাবে | কিন্তু চাকরি পেয়েও রক্ষা হল না মেয়েটির | মেয়েটি বেতন পেতেই তা স্বামীর হাতে তুলে দিতে হত | স্বামী সব নির্ধারণ করে দেয় যে কিভাবে কোথায় আর কত খরচ করবে | দেলোয়ারের কন্যাজামাতার তার শশুরশাশুড়িকে বুঝতে দেরি হয়নি | সে বুঝে গিয়েছিল যে স্ত্রীকে কিকরে কলের পুতুলের মত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে | সে স্ত্রীর বেতনের দশহাজার টাকা টাকা শশুর শাশুড়িকে পাঠিয়ে দিতে লাগল | দেলোয়ার তো খুব খুশি ! বাহ্ ! এইতোনা পুরুষের মত পুরুষ | একবার দেলোয়ারের মেয়ে এসে বলেছিল যে স্বামীর অনুমতি ছাড়া একগ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে খাবার সাহস তার নেই | মেয়েটি যমের মত ভয় করে স্বামীকে | কিন্তু মেয়ের কোন অভিযোগ দেলোয়ার শোনেনা | তার একটাই কথা মেয়েরা থাকবে নিয়ন্ত্রণে |
দেলোয়ার ছেলের বিয়ের সময় কোনভাবেই তাকে নিজের পছন্দে বিয়ে করতে দিলো না | ছেলেটির একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল | তার কলেজেরই একটি মেয়ে, তার চেয়ে তিনবছরের জুনিয়ার | মেয়েটি দেখতে মিষ্টি, কথাবার্তায় মোহনীয় | খুবই পছন্দ করত মেয়েটিকে সে কিন্তু বিয়ে করতে পারলোনা সে বাপের বাঁধায় | দেলোয়ার এককথায় বলে দিল যে "কিছু করেনা মেয়ে ! বেকার মেয়ে কেন বিয়ে করবি ? একটা চাকরিবাকরি করে এমন দেখে একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেব তোর | এই মেয়ে আদুরে আহ্লাদে ধরনের ! এর সাথে বিয়ে চলবেনা | আর মেয়ের বাপই বা কেমন যে এতবড় মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে ঘরে পুষে রেখেছে ? না না এমন মেয়ে চলবে না ! একটা সচ্ছল আর উপার্জনক্ষম মেয়ে দেখে বিয়ে দেব !" ছেলে এবার বেঁকে বসলো | কিন্তু লাভ হলো না | ছেলের মা বাপের পক্ষ নিলো আর খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে দিনরাত ছেলে অভিশাপ করে গেল | এবার দেলোয়ার ওই মেয়ের বাবার কাছে গিয়ে বলল যেন সে নিজের মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে | কেননা দেলোয়ার একটা চরিত্রহীন মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেবে না ! যে মেয়ে প্রেম করে তার আবার চরিত্র আছে নাকি ! মেয়ের বাবা এসব শুনে মনের দুঃখে তার মেয়েকে আর মিশতে দেননি দেলোয়ারের ছেলের সঙ্গে | দেলোয়ার আর তার স্ত্রী মিলে এরপর অন্তত ত্রিশটার মত বাড়িবাড়ি মেয়ে দেখে অবশেষে একটা মেয়েকে পছন্দ করে তার সাথে ছেলের বিয়ে দিলো | মেয়েটি একটা সরকারি ব্যাংকে সেকেন্ডক্লাস অফিসার আর মেয়ের বাবা মেয়েকে কিছু নগদ টাকা দেবে | দেলোয়ার মহা উৎসাহে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলো | মেয়েটি দেখতে অসুন্দর, মোটা, মুখভর্তি দাগ | দেখতে কদাকার সেটা দোষের নয় | কিন্তু অত্যন্ত রুঢ়ভাষী | সবসময় দুর্ব্যবহার করে সবার সাথে | আর সে চাকরি করে এই গরমে সে মাটিতে পা ফেলে না | দেলোয়ারের তাতে কোন আপত্তিই নেই | চাকুরে বৌ অহংকার তো তার হবেই |
ছেলে বিয়ে করে সুখী নয় | এটা দেলোয়ারের বড় মেয়ে বলে | কিন্তু এসব কানেই তোলেনা দেলোয়ার | সুখ আবার কি আর কেমন করে খোঁজে ? এতভালো যোগ্য আর উপার্জনক্ষম মেয়ে বিয়ে করে আবার সুখি না কি কথা ! যত্তসব ন্যাকামো ! বৌ নিজের আয়ে চলে তাকে একেবারে সীমিত ব্যয়ভার দিতে হয় এরপর আর কি কথা ? আর মুখরা ? তা একটা উপার্জনক্ষম মেয়ের ঐটুকু মুখঝামটা তো শোনা যেতেই পারে | কিন্তু তার যোগ্যতাটাতো দেখতে হবে নাকি ? এতগুলো টাকা কামাই করে যে মেয়ে তার তো একটু দাপট থাকবেই | ওতো আর দোষের কিছুনা |
দেলোয়ার বড়মেয়েটার বিয়েও এভাবেই দিয়েছিলেন | বড় মেয়েটা সবার বড় | বড় মেয়েগুলো নরম হয় এমনিতেই এও তাই | বাপের মুখের উপর টু শব্দ করার সাহস নেই তার | মেয়েটাও বাড়ির সামনেই একটা কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়ে গেল | কারন সে আর্টসের ছাত্রী আর ঢাকার কোন পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে সে চান্স পায়নি | তার সে সাহসই হয়নি যে বাবাকে বলে সে ঢাকার বাইরে পরীক্ষা দেবে | অথচ তার তিনটা বান্ধবী যাদের রেজাল্ট তার চেয়ে খারাপ তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে গেল | কিন্তু দেলোয়ার মেয়েকে বলেই দিয়েছে যে ঢাকার বাইরে পা রাখার কথা ভাবলেও তার পা কেটে দেবে | সে তাই আর কোথাও যায়নি | সে এখানেই পড়েছে বাড়ির নিকটতম দূরত্বে এক কলেজে | এই মেয়েটিও নিজের খরচে পড়াশুনা করে চলত | সে অবশ্য থার্ড ইয়ারে থাকতেই তার চাকরি হল একটা এনজিওতে | এতে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো দেলোয়ার | কারন এনজিওতে ভালো কাজ পেয়েছে মেয়ে | এখন তার চিন্তা কম হল কেননা চাকরিজীবী মেয়ের দ্রুত বিয়ে হবে আর সহজে বিয়ে হবে ! হলোও তাই | ছেলে বিদ্যুৎ বিভাগের এক দ্বিতীয়শ্রেণীর কর্মকর্তা | বয়সে তার মেয়ের চেয়ে চৌদ্দ বছরের বড় | কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের সরকারি চাকুরে দেখে আর কারো কোন ওজর আপত্তি শোনেনি দেলোয়ার | আর তাছাড়া ছেলেদের নিজেদের বাড়ী, বড় যৌথ সংসার | বিয়ে দিয়ে দিলো সে | খুব গর্ব তার এ নিয়ে | কিন্তু ছয়মাস পরেই একদিন মেয়ে এসে কেঁদেকেটে পড়ল | কারন স্বামী খুব গায়ে হাত তোলে আর শাশুড়ি অত্যন্ত বদমাস মহিলা | সারাদিন অফিস করে এসেও তাকে ঘরের সব কাজ করতে হয় | এরপরেও তার শাশুড়ি তাকে কথা শুনিয়ে উপায় রাখেনা | এতেও সে তৃপ্ত হয়না | সে ছেলে ঘরে এলে মাত্রই তার কনভারী করে | এরপর স্বামী মেয়েটির কোন কথা যুক্তি কিছুই শোনেনা আর বেধড়ক মারধর করে তাকে | মেয়েটি যা বেতন পায় তার সবটা শাশুড়ি নিয়ে নেয় | একবার সে নিজের বেতনের টাকা থেকে একটা শাড়ি কিনেছিল | এতে প্রথমে তার শাশুড়ি আর পরে স্বামী তাকে মারধর করে | এই অভিযোগ দেলোয়ারকে করলে দেলোয়ার মেয়েকে মুখের উপর বলেছিল "তুই নিজের দোষে মার্ খেয়েছিস !"
বছর দুয়েক পর একদিন তারা মেয়েটিকে মেরেধরে এককাপড়ে ঘর থেকে বের করে দিল | মেয়েকে এখানে চলে আসতে দেখে দেলোয়ারও পারলে মেয়েকে বের করে দেয় | সে বারবার বলল, "তুই এলি কেন ? মেয়েমানুষের স্বামী ছেড়ে আসতে আছে কোনদিন ? আক্কেলছাড়া মেয়ে ! মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হয় তাও শশুড়বাড়ির ভিটে ছাড়তে হয়না ! কি এমন করেছে ? দুটো চড়থাপ্পরই মেরেছে ! এজন্য এসে পড়লি ? আমি মানুষের কাছে মুখ দেখাবো কেমন করে ?"
দেলোয়ার পরদিনই জামাতাকে ডেকে এনে তার অভিযোগ শুনল | তার জামাতা বলল "আমি ওকে বলেছিলাম আমার বোনের বিয়ে যেহেতু তাই ওকে বলেছিলাম বাসা থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে আসতে | ও মুখের উপর না করে দিল ! বলে ও পারবেনা ! আচ্ছা আমি তো ওর স্বামী নাকি ? আমাকে অবিশ্বাস ! আমি কি ফেরত দেবোনা টাকা ?"
শশুর জামাতার দৃঢ় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে বলল "অবশ্যই | বাবা অবশ্যই ! আমার মেয়েকে আমি চিনিনা ! তখনই বুঝেছি ওর ভুল | তা তুমি চিন্তা করোনা বাবা | আমি দেখি কি করা যায় !"
দেলোয়ার তার জামাতাকে একলক্ষ টাকা ধার দিলো এবং বলা বাহুল্য সেই টাকা ফিরত আসেনি আর | এরপর অনেকবারই বিভিন্ন দরকার উপলক্ষে টাকা দিয়ে যেতে হয়েছে | যখনই সেটা আসেনি মেয়ের উপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন এসেছে | একবার মারের চোটে একটা চোখ বন্ধ আর আর গালমুখ আঙ্গুল ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছে এমন অবস্থায় সে বাপের বাড়ী এলো দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে | সে বাপের পা ধরে কান্নাকাটি করল যে সে আর ফিরতে পারবেনা | শাশুড়ি রোজ মারে তাকে | আর সামান্য কিছু ভুল হলে স্বামীর মার তো আছেই | সে বারবার অনুনয়বিনয় করল বাপের কাছে যেন সে একটু ঠাঁই দেয় মেয়েকে | সে যে চাকরি করে সেই আয়েই সে দুই বাচ্চাকে পড়াবে | শুধু একটু থাকার জায়গা চাইল সে | কিন্তু দেলোয়ার দিলোনা | সমাজের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে সে যদি মেয়ে এবাড়ি এসে থাকে তো ! কি জবাব দেবে মানুষের প্রশ্নের ? না না ! এ হবে না | দেলোয়ারের ছেলে অনেক অনুরোধ করলেও দেলোয়ার দিলোনা কিছুই করতে ছেলেকে | সে জামাইকে ডেকে মীমাংসা করে দিলো |
দেলোয়ারের স্ত্রী বোঝালো যে শাশুড়ি তো মায়ের মত ! তার শাসন কি ধরতে হয় ? সেতো ভালোর জন্যই করে | সে মারলেও সোয়াব | আর স্বামীর মার তো সৌভাগ্য ! স্বামী যেখানে যেখানে মারবে সেই জায়গাগুলো বেহেস্তে যায় ! আর শাশুড়ির উপর রাগের কি হল ? সে বুড়োমানুষ বাঁচবেই বা আর কয়দিন ! একটু মেনে নিয়ে চললেই হয় | দেলোয়ারও মেয়েকে বুঝ দিলো যে মেয়েমানুষের জীবনে বিয়ে একবারই হয় | আর প্রত্যেক ঘরে একটুআধটু এমন হয়ই ! এটা কিছুনা | মেনে নিলেই আর কথা নেই কোনো | আর মেয়ের কি মাথা নষ্ট নাকি সে তালাক দিতে চায় স্বামীকে ? এটা কোনদিন সম্ভব না | কোনদিন না | এতো কবিরা গুনাহ ! দেলোয়ার মেয়েকে বলল যে তালাক যদি দেয় সে স্বামীকে তাহলে তাদের লজ্জার শেষ থাকবেনা | সম্পূর্ণ পরিবারের মানইজ্জত ধুলোয় মিশে যাবে | ছি ছি ছি ! সারা দুনিয়ার মানুষ জানবে যে সে তালাকপ্রাপ্তা ! কি লজ্জা , কি শরমের কথা ! একটা ভালো ঘরের মেয়ে কখনোই স্বামীকে তালাক দেয়না তা স্বামী চোর, ডাকাত, মাতাল, নেশাখোর, অপরাধী, অত্যাচারী যাই হোকনা কেন ! স্বামী হচ্ছে স্বামী, তাকে মানতেই হবে | আর জামাই তো সোনার মানুষ, শুধু গায়ে হাত তোলে একটুআধটু ! একি কোন সমস্যা নাকি ! মেনে নিলেই হয় | আর ছেলেমেয়ে বড় হলে এমনিতেই থেমে যাবে |
দেলোয়ারের মেয়ে সেই যে গেল এরপর আর আসেনি সে | কিন্তু তার স্বামীর অত্যাচার কিন্তু থামেনি | এটা ব্যাপারনা | আপনিই থেমে যাবে একসময় | কিন্তু মনজুর তাক দেন দেলোয়ারের বুদ্ধির | কি দারুণকরে সবগুলো ছেলেমেয়ের জীবন গড়ে দিয়েছে সে | হাতের মুঠোয় রেখে সবকটাকে মানুষ করে গড়েছে সে | সে এমন নিয়ন্ত্রণ করেছে বলেই তো মেয়েগুলো সব সাবলম্বী আর ভালো ভালো বিয়ে হয়েছে | আর ছেলেটাকেও তাগাদা দিয়ে দিয়েই জায়গামত পৌঁছে দিয়েছে সে | বিয়েও দিয়েছে যোগ্য মেয়ের সাথে |
মনজুর বসে বসে ভাবছিলেন দেলোয়ারের কৃতিত্ব নিয়ে ভাবছিলো | ইস এভাবে যদি তার সন্তানেরা তার কথা শুনতে রাজি হত তো তাদেরও জীবনটা আজ কত আলাদা আর উন্নত হত ! ঠিকই বলে দেলোয়ার, আজমত, খসরু, আলিম এরা | তিনি বেশিই স্বাধীনতা দিয়েছেন এদেরকে | এজন্যই কিছু হলনা এদের | অথচ ওদের ছেলেমেয়েগুলো আজকে কোথায় পৌঁছে গেছে ! তার উচিত ছিল আরো শক্তহাতে এদেরকে লালনপালন করা কিন্তু অনেক ঢিল দিয়েছেন এদের তিনি |
আর আইলান কাল বাদশা আর বাদশার মেয়েগুলোর নামে কিসব বলল | আচ্ছা বাদশা যদি ওদেরকে এতটা কড়াকড়ি না করত তাহলে কি ওরা এমন অর্থসম্পদশালী আর প্রতিষ্ঠিত হতে পারত আজকে ? কখনোই না ! বাদশা বের করে দিয়েছিল বলেই নিজেরা নিজেদের গড়েছে | আর ওসব তো শোনা কথা ! আর যদি গিয়েও থাকে বিপথে তবে কি বাদশা তাকে বলত না ? অবশ্যই বলত | এখন তো মেয়েরা তিনজনই টাকা পাঠায় বাপকে | তো কর্মক্ষম মেয়েদের সমাদর না করলে কাদের করবে ? বাপ যদি বের না করে দিত তবে এত পয়সা হত ওদের কখনও ?
আজান হয়ে গিয়েছে | মনজুর নামাজ পড়ে তসবি পড়লেন | আজ একবার গেলে কেমন হয় দেলোয়ারের কাছে ? যাওয়া যেতে পারে | নাহ, যাবেনই আজ | এমন সময়ে মনে পড়ল তো যাওয়াই ঠিক |
.
.
মনজুর সকাল সকালই ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘর গেলেন | ময়না সদ্য নাশতা বানাতে বসেছে |
তিনি ময়নাকে বললেন, "তুমিও ওদের মত কুইড়া হইলা ! তুমি তো আগে সকালে আসতে ? কি হইল তোমার ?"
ময়না বলল, "খালু অখন তো সাড়ে ছয়ডা বাজে কেবলি ! এরথেন আগে আর কুহূনা আমু ?"
"ভোর হয় কয়টায় জানো ? জানোনা ! আমি সেই ভোরে উঠি | উইঠা আমি নামাজ পইড়া বইসা থাকি | এরা কেউ সকালে ওঠেনা | অথচ যে ব্যক্তি সকালে উঠবেনা তার উন্নতি যোগ্যতা কিছুই নাই | কিছু হবে না তারে দিয়ে |"
ময়না আর কথা বলল না | সে জানে খালুর মাথায় কখনও কখনও ছাট ওঠে | সেসময় খালু অনেকবেশি অদ্ভুত কথা বলে | অকারনে খিটখিটে হয়ে থাকে আর ঝগড়া করে | ইদানিং বেশি হচ্ছে তার মাথায় ছাট | তবে খালুর ছেলেমেয়েগুলো ভালো তাই সহ্য করে নইলে এখনকার পুলা মাইয়ারা বুড়াদের জায়গায় দেয়না | আর দেবেই বা কেন ? যেই উৎপাত করে এরা ! সেতো দেখেই | ঘরে তো তার শশুরই আছে | যন্ত্রনা করে অস্থির করে |
ময়না অনেক সাধাসাধি করল মনজুরকে নাশতা করে যাবার জন্য | কিন্তু সে দেরি হবে বানাতে এই উদাহরণ দিয়ে চলে গেল |
রাগই হল ময়নার | এমন কেন মানুষটা ? এত্ত জ্বালাতন করে সবাইকে ! অস্থির করে দেয় সবাইকে | আচ্ছা সে যাবে হাঁটাহাঁটি করতে কি হয়ত কোন ছোটখাটো কাজে অথচ সে কেন এমন করে ? অকারনে সকালবেলা সবাইকে অস্থির করে তোলে | কি লাভ হয় এতে তার ? কতক্ষন লাগত নাশতা বানাতে তার ? বড়জোর আর পনেরো বিশ মিনিট দেরি করলে কি এমন হত ! আজব লোক একটা ! আর অবাক লাগে তার যে এই লোকের মত কটূভাষী লোকের দুই সন্তানই এমন মিষ্টভাষী ভদ্র ! আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কি এটা !
.
.
মনজুর এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে দেখলেন বেশ কয়েকজন লোক এত সকালেও দরজার সামনে | এগিয়ে গিয়ে দেখলেন পাঁচতলার এক বাসিন্দা দম্পত্তি আর কিছু লোকজন | তবে কিছুক্ষনেই জানলেন এদের মধ্যে দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ | কি ব্যাপার ? পুলিশ কেন ?
কিছুক্ষন অপেক্ষার পর জানলেন যে পাঁচতলার বাসিন্দা এই প্রকৌশলী দম্পত্তির পনেরো বছরের কিশোর ছেলেটিকে পাওয়া যাচ্ছেনা | সে দুদিন ধরে নিখোঁজ | আশ্চর্য ! এ কথাটা কাল তো কেউই বলেনি ঘরে তাকে ! তিনি জিজ্ঞাসা করে জানলেন যে ছেলেটা দুদিন আগে স্কুল থেকে আর ফেরেনি | বাবামা ভেবেছিল স্কুল থেকে সরাসরি কোচিং গিয়েছে | সে চারটা কোচিংয়ে যায় রোজ | ছেলে নাকি কাউকেই কিছু বলেনি চলে গিয়েছে | রাগে গা জ্বলছে মনজুরের | আশ্চর্য এসব ছেলেপুলেরা ! বাপমায়ের চিন্তা কি বোঝেনা নাকি !
.
ঘরে যেতে গিয়েও আর গেলেননা মনজুর বরং ফোন করলেন ঘরে | ফোন মাহিরা ধরল |
ফোন ধরতেই মনজুর বললেন, "কি ব্যাপার বৌমা ? এতো সকালে উঠেছ যে তুমি ? সকালে ঘুম থেকে ওঠা তো ঠিক না ! এটা তো খারাপ কাজ ! সকালবেলা তো ঘুমাতে হয় |"
মাহিরা গম্ভীরভাবে বলল, "এত সকালবেলা কোথায় বেড়িয়েছেন বাবা ? কোথা থেকে ফোন করেছেন ?"
"এখন কি আর সকাল আছে ? দিন শুরু হয়ে গেছে | তোমাদের তো ঘুমোই ভাঙ্গেনা |"
"বাবা কিছু বলবেন ?"
"হ্যা | তোমরা জরুরি কথা বলোনা | তোমাদের হল সব অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা !"
"বাবা কি হয়েছে সেটা বলুন | আমাদের অনেক দোষ সেটা আমি জানি |"
মাহিরার তীক্ষ্ণকণ্ঠে একটু মিইয়ে গেলেন মনজুর |
তিনি বললেন, "না মানে আজকে নিচে নেমে দেখলাম পুলিশ | ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ছেলেকে নাকি পায়না দুদিন ধরে | কই তোমরা তো বললে না কিছু |"
"এতে বলার কি আছে বাবা ! কিছুই নেই বলার |"
"হায় হায় ! বলো কি গো ?"
"হায় হায় কেন করছেন ?"
"একটা বাচ্চা নিখোঁজ আর তুমি বলছো কিছুই হয়নাই ? এ কেমন কথা হল ? ওর বাবামা কেঁদেকেটে অস্থির |"
"ওহ ! এজন্যই ফোন করেছেন ?"
"তুমি না আইনের মানুষ ! তুমি এমন করে কথা বলো ?"
"হ্যা বলছি | ওর বাবামায়ের কান্নায় আমার একটুও কষ্ট হচ্ছেনা |"
"কেন ? তুমি নিজে একটা মা হয়ে একথা বলো ?"
"আমি মা বলেই বলছি | ওই মহিলার কান্না দেখে আমার কোন কষ্ট হচ্ছেনা |"
"এসব কি বলো ? এসব বলা ঠিক না | অজ্ঞানের মত কথা বলোনা |"
"বাবা আপনার কাছে আমি জ্ঞানের শিক্ষা নিতে চাইনা | আপনি অন্তত জ্ঞান/অজ্ঞান নিয়ে কথা বলবেন না | আপনি এর কিছু জানেন যে ছেলে কেন নিখোঁজ ? জানেন না ! ছেলেটা আসলে নিখোঁজ না, ও ওর বাবামাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে |"
"ছি ছি ছি ! বদমাইশ ! এত্তবড় হারামি | মাবাপের সাথে এসব আচরণ ? ছি |"
"ছি কেন বলছেন বাবা ? ওহ ! আমি তো ভুলেই গিয়েছি যে আপনি তো ছি বলবেনই |"
"এটা তো ছি ছি করার মতোই কাজ | মা বাপ কত কষ্ট করে একটা সন্তানের জন্য | আর এসব ফাজলামো করে চলে যায় এরা ! আমি হলে কোনদিন খোঁজ করতাম না |"
"সেটা জানি |"
"এত কষ্ট করে যারা ওদের জন্য তাদের প্রতি এই আচরণ ! একি মানুষের কাজ ?"
"বাবা চারতলায় খিদমত সাহেবের মেয়েটাকে দেখেছেন ? তন্বী ? এই যে বললেন না কথাটা মা বাপ এত কষ্ট করে আর তাদেরকে দুঃখ দেয়া খারাপ এটা ওই তন্বীর জন্য প্রযোজ্য | তন্বীকে চেনেন না ?"
"হ্যা চিনি তো |"
"তন্বী তিনবছর হল ড্রাগ ধরেছে | ওর বাপ ফরেস্ট অফিসার আর মা একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের টিচার | দেখুন কত কষ্ট করে | মেয়ে যা চায় তাই এই দেয় | ছোটবেলা থেকেই খুব জেদি নাকি ও | যেটা চাই এনে না দিলে অশান্তি, ভাঙচুর, চিৎকার এসব করত | এখনও করে | এখন ও ড্রাগের টাকা না পেলে মাবাপকে ধরে মারে পর্যন্ত |"
মনজুর নরমগলায় বললেন, "এটা তো বাচ্চাটার দোষ না, এটা হল বাপমায়ের দোষ | বাপমা যদি প্রথম থেকে ওকে বুঝ দিত ঠিকমত মানুষ করত তাহলে এমন করত না | এখন হয়ে গেছে এমন তাই এখন আর কি করবে | বাপমায়ের মনে কষ্ট লাগে সন্তান যেহেতু | কিন্তু এরা ঠিক হয় ঠিকই |"
"বাহ্ ভালো যুক্তি দিলেন তো বাবা ! একটা জিনিস কি আজব না বাবা ?"
"কি বৌমা ?"
"এইযে শান্তশিষ্ট, চুপচাপ, ধীরস্থির, ভদ্র, সহনশীল বাচ্চাগুলোকে বাবামায়েরা প্রায়ই দেখা খুব কষ্ট দেয় | খুব ! আমি সবার কথা বলছিনা কিন্তু বেশিরভাগই | এই বাচ্চাগুলো বেয়াদব না আর এরা বাপমাকে অপমান করতে পারেনা | আর এরাই কি প্রচন্ড কষ্ট পায় | কিন্তু এইযে যেই বাচ্চাগুলো জন্মগতভাবেই উগ্র, অসভ্য, বেয়াদব, উশৃঙ্খল, বেয়ারা এদের প্রতি কি মায়া বাবামায়েদের ! এমনকি এই যে দেখুন আপনিও এদেরকে দরদ দেখিয়া কথা বলছেন | বাবা যেই ছেলেটা পালিয়েছে মানে গগন ও কেন পালিয়েছে জানেন ? কারন বারবার ওর মাবাবা একই কথা ওকে বলেছে যে "যেমন চাই সেরকম ফলাফল যদি না করতে পারিস তো ঘর থেকে বের হয়ে যাবি !" ও তাই করেছে যেমনটা ওর বাবামা বলেছে ! ছেলেটার মা আর বাবা ইঞ্জিনিয়ার | তারা ছেলেকে আর্কিটেক্ট বানাতে চান | বাবামা দুজনেই বুয়েট থেকে পড়াশুনা করেছেন আর ছেলেকেও সেখানে দিতে চান এজন্য এখন থেকেই তোড়জোড় | তারা যা চাই সেটা করতে তারা যা পারছেন করছেন | ছেলে পড়তে চায়নি সাইন্স নিয়ে কিন্তু সাইন্সই ভর্তি করেছেন, চারটা কোচিং আর দুটো গৃহশিক্ষক তার | সে সকালে কখন ঘুম থেকে উঠবে তা থেকে নিয়ে শুরু করে রাতে কখন ঘুমাতে যাবে সেটা পর্যন্ত তার বাবামায়ের নির্ধারিত | ও একদিন একটা গল্পের বই এনেছিল কিনে | ওর মা ওটাকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে | ওদের ঘরে একটা টেলিভিশন যেটা বসার ঘরে | সেই টেলিভিশনের তারের সাথে লাগানো মাল্টিপ্লাগ আর কেবলের জ্যাক ওর বাবা খুলে নিয়ে চলে যায় সকালে অফিস যাবার আগে যাতে ছেলে টিভি না দেখতে পারে | ঘরে ইন্টারনেট কানেকশন নেই | ওর বাবা ওকে কোন স্মার্টফোন কিনে দেয়নি যাতে ফোনেও ইন্টারনেট না দেখতে পারে | কোথাও খেলতে যেতে দেয়না কি কারো সঙ্গে মিশতে দেয়না পড়া নষ্ট হবার ভয়ে | নিজের পছন্দের কোন খাবারও ওকে দেয়া হয়না | ওকে ওরা বন্দি করে রেখেছে | এরপরেও ওদের আশা মিটলোনা | সারাদিন ছেলের পিছনে খিটখিট | ক্লাস নাইনে ফাইনালে এপ্লাস পায়নি তাই ওর বাবা রেজাল্টের দিন গ্যারেজেই মারধর শুরু করেছিল | এবার টেনেও প্রথম সাময়িকের ফলাফল ভালো হয়নি ওর এই ভয়ে অস্থির ছিল ও | চারদিন আগে সেই রেজাল্টের কথা ওর বাবা জেনেছিল আর রাতের বেলা ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল | ওদের পাশের ফ্ল্যাটের ডাক্তার ভদ্রলোক সেদিন বেশ রাতে ফিরেছিলেন চেম্বার থেকে | উনি ঘরে যেতে গিয়ে দেখেন ও সিঁড়িতে বসে আছে | পরে উনি ওকে উনার ঘরে নিয়ে যান | ছেলেটা সেদিনই ডাক্তার সাহেবকে বলেছিল যে সে চলে যাবে | একথা শুনে ওর বাবা মা হেসে অস্থির হয়েছিল | আর এখন সত্যিই চলে গিয়েছে তখন নাকিকান্না জুড়ে দিয়েছে | এই মহিলার কান্নায় তাই আমার একটুও কষ্ট লাগছেনা |"
মনজুর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, "দ্যাখো, আমার চিন্তাভাবনা তো তোমাদের মত না | আমি ভাবিনা কিছু তোমাদের মত | আমি যেটা সঠিক সেটাই বলব | এখন এই ছেলেটা তুমি যে বললে সেটা এই বুঝি আমি যে ওর বাপমা শুধু সেই চেষ্টাই করেছে যাতে ওর ভবিষ্যৎ গড়া হয় | এখন সে যদি এটা এরকম করে তো এটা আফসোস ! সে এটা যে করলো এটা অনেকবড় অপরাধ করল | এই অপরাধের মাফ নেই | ওর উচিত ছিল..................."
মনজুর শেষ করতে পারলেন না তার কথা | মাহিরা হা হা করে উচ্চস্বরে হেসে ফেলল |
মনজুর বিস্মিত হয়ে বললেন, "কি হল বৌমা হাসো কেন ? এতে হাসার কি হল ?"
মাহিরা হাসি থামিয়ে বলল, "হাসিরই তো কথা বাবা | আপনি কিছুক্ষন আগে একটা ড্রাগএডিক্ট মেয়ের পক্ষ নিলেন | অথচ একটা নিরীহ ছেলের আপনি দোষ খুঁজে পেলেন আর ওর ওই কুলাঙ্গার কালপ্রিট মাবাবা ওদের পক্ষ নিলেন যারা বাপমা নামের কলঙ্ক | একটা ছেলে যে এখনও শিশু সে কতটা কষ্ট পেলে সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় এককাপড়ে ঘর ছেড়ে দেয় তা বোঝার মত বিবেক আর মমতা আপনার নেই | অবশ্য আপনি নিজের ছেলেকেই মায়া করতে পারেননি কখনও অন্যের ছেলেকে কি দরদ করবেন !"
মনজুর তার পুত্রবধূর এমন ব্যবহার আর কখনও পাননি | তিনি আহতস্বরে বললেন, "তুমি এই কথা বললে বৌমা ?"
"হ্যা বললাম | কারন দেখেছি বলেই বললাম |"
"আমাকে তুমি কোনদিন আমার ছেলেকে দরদ করতে দেখোনি ?"
"দেখেছি কখনও কখনও | কিন্তু সেটা আমার সন্দেহ হয় | কারন এখন দরদ করে ঘন্টাখানেক পরেই কলজে চিরে দেন আপনি | আর আপনি শুধু নিজের ভাবনাটাই সঠিক মনে করেন | অন্যের ভাবনা কখনোই ভাবেননা | এমনকি আইলানেরও না |"
"আমি ওর কথা ভাবিনা ?"
"না |"
"কবে কি করতে দেখেছো আমাকে যে এরকম বললে ?"
"কতবারই তো দেখলাম বাবা | কেন অতবেশি খুঁটিনাটি উদাহরণ কেন দিতে হবে ? আমাদের বিয়ের সময়ের কথাই তো মনে আছে আমার | আপনি কি করেছিলেন আমার সব মনে আছে |"
মনজুর হরগর করে বললেন, "ঐসময় আমি ছিলাম অসুস্থ | তখন কি বলেছি না বলেছি তাতো ধরার কিছুনা |"
"সবকিছুই ধরার মত | সবকিছু | আমি বলছিনা যে তখন অসুস্থ ছিলেন না আপনি | আপনি তখন নিজের অসুস্থতাটাকে ব্যবহার করেছিলেন ছেলের মন ঘুরাতে | যখন আমাদের বাগদান হয়ে গিয়েছে এ অবস্থায় আপনি বন্ধুর মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে ঠিক করলেন | ওর কথা যদি ভাবতেন তো এমনটা করতে পারতেন না | আমি তো পরের মেয়ে, আমার যন্ত্রণার কথা বাদ দিন | কিন্তু আইলান তো আপনার ছেলে | একবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন যে কি প্রচন্ড কষ্টটা ও পেয়েছিল আপনার আচরণে ? কি আঘাতটা ওর মনে দিয়েছিলেন ? ভেবে দেখেছিলেন কখনও ? ভাবেননি | এত মায়া আপনার মধ্যে নেই |"
মাহিরা ফোন রেখে দিল |

You've reached the end of published parts.

⏰ Last updated: Nov 23, 2019 ⏰

Add this story to your Library to get notified about new parts!

মেঘের আলোয়Where stories live. Discover now