পর্ব ৪৯

Start from the beginning
                                    

আলিজা মেয়ের ঘরে গিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখতে লাগল | ম্যাডিসন একগাদা জিনিসপত্র প্যাকেট করছে |
আলিজা সামনে এসে দাঁড়িয়ে হেসে ফেলে বলল, "সোনা এসব কি করছো তুমি ?"
ম্যাডিসন ফিক করে হেসে ফেলে বলল, "মা এসব নিয়ে যাবো আমি |"
"এই এতগুলো মাটির পুতুল, ফুলদানি, বাঁশবেতের জিনিস তুমি আমেরিকায় সাথে নিয়ে যাবে ?"
"না মা | আমি এগুলোকে শিপিং করে দেব কাল | আংকেল এলান ব্যবস্থা করে দিয়েছে সব | কাল সব লোকজন এসে এগুলো নিয়ে যাবে | আমি এখন প্যাকেট করে তালিকা করছি | আমরা পৌঁছানোর পরপরই এগুলো পেয়ে যাবো |"
"পাগল মেয়ে ! এসব দিয়ে কি করবে মামনি ?"
"এতসুন্দর জিনিসগুলো ! সব সাথে নিয়ে যেতে ইচ্ছা হয় | আর মা আমি সত্যিই ভাবিনি এখানকার হস্তশিল্প এতো সুন্দর !"
"সেটা অবশ্যই সত্যি | এদেশের কর্মীদের হাতে জাদু আছে |"
ম্যাডিসন একটা কাঠের খোদাইকরা দেয়ালঘড়ি তুলে ধরে বলল, "দ্যাখো মা | কি সুন্দর না ?"
"হুম | খুব সুন্দর |"
"আচ্ছা তুমিও তো অনেককিছুই কিনেছো | ওগুলো কি করবে ?"
"নিয়ে যাবো কিছু |"
"আর বাকিগুলো ?"
"ওগুলো কি আর নেয়া যাবে মামনি ! এতসব কি নেয়া যায় ! সোনা বিদেশে থাকার এটাই সবচেয়ে বড় কষ্ট | চাইলেই দেশের ভেজা মাটি আর সতেজ বাতাসটা পাওয়া যায় না | পরতে পরতে দেশের গান গাইতে থাকা এই সূক্ষ্ম জিনিসগুলো হাতবাড়ালেই পাওয়া যায়না | দেশকে মনে অনুভব করা যায় কিন্তু হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় না |"
"মা ?"
"কি সুইটি ?"
"তুমি খুব কষ্ট পাবে দেশ ছেড়ে গেলে তাইনা ?"
"হুম | সেটাই তো স্বাভাবিক মা | "
"মা আমি তোমার জন্য একটা কাজ করবো এবার |"
"কি সোনা ?"
"তোমার সব পছন্দের জিনিসগুলো নিয়ে যাবো সাথে যাতে যতটা সম্ভব কম কষ্ট পাও তুমি |"
আলিজা হেসে ফেলল মেয়ের কথা শুনে |
.
.
.
রাতে মেয়ের ঘরে ঢুকতে গিয়ে আইলান প্রায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো | সারাঘরে রংপেন্সিল আর ক্রেয়ন |
আইলান সব তুলে সরিয়ে রেখে বলল, "মা কি করছো এসব ? এভাবে ঘর নোংরা কেন করেছো মা ?"
কথা বাপকে দেখে খি খি করে হেসে বলল, "ছবি আঁকছি বাবা | এই দ্যাখো !"
সে অতি আগ্রহে একটা হিবিজিবি ধরনের ঘরবাড়ির ছবি আইলানকে দেখাতে লাগল |
এরপর সে আরেকটা ছবি এনে বাপকে দেখিয়ে বলল, "দ্যাখো বাবা এটা কত সুন্দর হয়েছে ! জানো এভাবে রং মিলাতে কে শিখিয়েছে ? আজকে ফুপুমনি শিখিয়ে দিয়েছে |"
"বাব্বাহ ! আজকে তো অনেক ব্যস্ত দিন কাটিয়েছো মা তুমি | অনেককিছু শিখলে !"
"হ্যা বাবা | বাবা জানো ফুপুমনি বলেছে আমাকে জলরং কিনে দিবে যাবার আগে | জলরঙে কি হয় জানো ?"
আইলান মেয়ের আগ্রহের জন্য জিজ্ঞাসা করল, "কি হয় তাতো জানিনা মা !"
"ধুর বোকা বাবা ! তুমি কিছুই জানোনা |"
"আচ্ছা তুমিই বলো মা |"
"জলরং হল পানিতে গুলে রং করে | জানো বাবা আমাদের দেশের অনেক বড়বড় পেইন্টার জলরঙে ছবি করে | সারা পৃথিবীতে আমরা সেরা ! কি দারুন না বাবা !"
"অবশ্যই দারুন মা | আচ্ছা আর কি বলেছে ফুপুমনি ?"
কথা চিন্তা করতে করতে বলল, "উমম........... হ্যা আরো বলেছে জলরং আমাদের মত কেউ পারেনা | জলরং আঁকতে কিন্তু তুলি লাগে জানো তুমি ?"
আইলান ঠোঁটটিপে হেসে বলল, "না মা | জানিনা আমি |"
"আমি জানি | জলরং দিয়ে তুলির টানে ছবি হয় | ঐযে লিভিংরুমে আছে না দুটো ছবি ওগুলো জলরঙে ছবি |"
আইলান অবাক বিস্ময়ে মেয়ের মুগ্ধতা দেখতে লাগল | কথা উচ্ছলভাবে হরগর করে তার নতুন আগ্রহ নিয়ে বকবক করে যাচ্ছে | আইলানকেও মেয়ের সাথে বসে তার ছবি আঁকা দেখতে হল |
.
.
রাতে খেতে আইলান বোনকে বলল, "ভালো জিনিসের সন্ধান পেয়েছিস তো তুই !"
আলিজা একটু হেসে বলল, "তাই নাকি !"
"তাইতো দেখছি | আমার মেয়ের তো খুবই আগ্রহ এর প্রতি |"
"সেটা দেখেই তো বললাম |"
"সেই তো বলছি | ওর প্রচন্ড আগ্রহ তৈরী হয়েছে |"
"ওটা ওর আগ্রহ নয় ভাইয়া, ইচ্ছা বলতে পারিস | আমি ব্যাপারটা লক্ষ করেই বললাম | এসে পরেই দেখেছি ও এটা করতে চায় | ভাইয়া একটা অনুরোধ করবো ?"
"ওমা ! তোর আবার অনুরোধের কি হল ! বল কি বলবি ?"
"ভাইয়া ওর আগ্রহটা নষ্ট করিস না | আমি পারিনি কিন্তু ও যেন তা পারে করতে |"
আইলান আশ্বাসের হাসি দিল একটা, বলল, "মনটা অনেক বড় থাকলেই মানুষ তোর মত হয় | আমি ওর ইচ্ছা পূরণ করবোরে লক্ষ্মী | ও যদি পেইন্টার হতে চায় তো ও তাই হবে |"
মনজুর তখনই মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, "এসব আজেবাজে জিনিস নিয়ে মাতামাতি করিস না | এসব ফালতু চিন্তা বাদ দে |"
আইলান কথা বলতে গেল কিন্তু আলিজা তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বলল, "তুই কথা বলিস না ভাইয়া | আমি বলি |"
মনজুর রুক্ষভাবে বলল, "তোর এখানে কিছুই বলার নেই | নিজে তো কোনদিনই কিছু করতে পারিসনি | এখন ওর মাথা নষ্ট করতে হবে না তোকে |"
"আচ্ছা ! মেনে নিলাম আমি আমার জীবনে কিছুই করিনি কিন্তু আমি যা করতে পারিনি তা ও কেন করতে পারবেনা ?"
"এটা ফালতু আর মূল্যহীন | তুই তোর মত ওকে নষ্ট করবিনা |"
এরিক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "লিজ ঘরে চলো | আমরা পরে খেতে বসবো | ড্যাড, ম্যাডি ওঠো তোমরা |"
আলিজা এরিকের দিকে চেয়ে বলল, "উঠছি | আর কথা দিচ্ছি এই ছয়দিন যে আছি এই প্রতিদিনই আমরা পরে খেতে বসবো | কিন্তু এখন কিছু কথা বলেই তবে যাবো |"
আইলান বাপের দিকে চেয়ে বলল, "কাজটা না করলে কি তোমার হত না ? কেন এমন করলে ? প্রত্যেকটা সময় একটা সুন্দর মুহূর্ত নষ্ট না করলে কি তুমি শান্তি পাওনা ?"
"যেটা সঠিক আমি সেটাই বলেছি | ও এখন পড়াশুনা করবে | বড় হয়ে ভাল কোন বিষয়ে পড়ে ভালো জায়গায় চাকরি করবে | তখন বুঝবি আমি কি বলছি !"
আলিজা বসে পড়ে বলল, "বাবা একটা প্রশ্নের উত্তর চাই | ছবি আঁকা, ভাস্কর্য গড়া, হস্তশিল্প এগুলো তোমার কাছে ফালতু কেন মনে হয় ?"
মনজুর দুহাত আড়াআড়ি করে বুকের উপর রেখে বসে বললেন, "এগুলো আমার কাছে সবসময়ই মূল্যহীন | যা কোন কাজে দেবে না তার কোন মূল্য নেই আমার কাছে |"
"আচ্ছা ? এসব মূল্যহীন ? ঠিক আছে ! এখন আমি যে প্রশ্নগুলো করব তার উত্তর তোমাকে দিতে হবে |"
"তোর কোন আজিরা কথার জবাব নাই আমার কাছে |"
আলিজা স্পষ্ট জোরগলায় বলল, "দিতে হবে তোমাকে জবাব |"
মনজুর একটু অবাকই হলেন | আলিজা বলল, "বাবা ষাটের দশক থেকে নিয়ে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের খুব প্রসিদ্ধ কিছু ধনীদের নাম আর তাদের কৃতিত্বগুলো বলো | মানে তারা কেন বিখ্যাত তা বলো |"
মনজুর বেশ কিছুক্ষন চিন্তাভাবনা করে কয়েকজনের নাম বললেন |
আলিজা বলল, "এরা নব্বই দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত ব্যক্তিরা | এখন এর আগের সময়ের গুলো বলো |"
মনজুর অনেক চিন্তা করেও কিছুই বলতে পারলেন না |
আলিজা বলল, "বাবা তুমি জয়নুল আবেদীনের নাম জানো নিশ্চই ?"
মনজুর ভুরু কুঁচকে বলল, "দুপাতা পড়ে নিজেকে এতো বিদ্বান ভাবিস কেন ? আমি জয়নুল আবেদীনকে চিনবোনা ? কি বলিস !"
"আচ্ছা | কামরুল হাসান ?"
"হ্যা চিনি |"
"এস এম সুলতান ?"
"ওতো নামি আর্টিস্ট |"
"সাইফুদ্দিন আহমেদ ?"
"ওরও নাম শুনেছি | হয়তো চিনি |"
"আহমেদ সাহাবুদ্দিন ?"
"নামটা যেন কোথায় পড়েছি |"
"মোস্তফা মনোয়ার ?''
"আরে হ্যা হ্যা চিনি |"
"শিশির ভট্টাচার্য ?"
"কার্টুন আঁকে যে ? চিনবোনা কেন ?"
"রফিকুন্নবী ?"
"ধ্যুত ! কি পাগলের মত কথা বলিস ? ওকে আবার কে না জানে !"
আলিজা একপেশে হেসে বলল, "কি আশ্চৰ্য ব্যাপার না বাবা এটা ?"
"কি ?"
"তুমি হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র ধনীলোকের নাম বলতে পারলে | কিন্তু তারা কেন বিখ্যাত তা মাত্র দুজনেরটা জানো | অথচ পঞ্চাশ দশক থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত আমার উল্লেখ করা সবগুলো নামি চিত্রশিল্পীকে তুমি চিনলে | এমনটা কেন হল বাবা ?"
"তোরা তো বুঝিস বেশি এজন্য এই অবস্থা | আল্লাহতায়ালা সবাইকে সমান জ্ঞান দেয়নি | তোরা যদি এটা বুঝতি তো হতোই | তোরা হলি বেশি চালাক |"
"আমি চালাক কি বোকা কি মহাগাধা তা কিন্তু জানতে চাইনি বাবা | শুধু এই জানতে চেয়েছি যে যেই টাকাকে আর অর্থকে তুমি সবথেকে মূল্যবান ভাব সেই অর্থবানদেরকে তুমি চেনোনা কেন ?"
মনজুর একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন |
আলিজা বলল, "মিশরের এত প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষর বহন করছে ওদের শিল্প | পিরামিড তৈরী করেছে ফারাওরা কিন্তু ওরাও এটা জানতে পেরেছিল বলেই করেছিল | ওরা বুঝতে পেরেছিল যে জগতে চিহ্ন রেখে যেতে হলে রেখে যেতে হবে কীর্তি | তাই ওরা এত এত ভাস্কর্য, ক্রিপ্টোগ্রাফি, হায়রোগ্রিফিক্স তৈরী করেছিল | ওরা যদি এই পড়ে পড়ে ফাস্ট হবে, এরপর এপ্লাস পেতে হবে আর এরপর ভালো বিষয়ে পড়ে পাশ করে চাকরি করত তো এই হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতা তৈরী হতনা ! সুমরুরা পাথরে খোদাই করে তাদের মহান সভ্যতা রেখে গিয়েছে | পুমাপুংকু আর টিওটিএকন-দের জ্যামিতিক ভাস্কর ওদের সভ্যতার উৎকর্ষতা বুঝিয়ে দেয় |"
মনজুর চুপ করে রইলেন |
আলিজা বলল, "কোন একটা সভ্যতা কতটা সমৃদ্ধ ছিল তা এ দেখেই নির্ধারিত করা হয় যে সে সভ্যতার শিল্পকলা কতটা উৎকৃষ্ট | শিল্প সবসময় সমাজের দর্পন | এই জিনিস সমাজের ছবি তুলে ধরে | যখন হাজারো গবেষনা চলছিল যে পম্পেই নগর ধ্বংশ হবার আগে কেমন ছিল তাদের জীবনযাত্রা তখন এর জবাব পাওয়া গিয়েছিল মাটি খোদাই করে পাওয়া তাদের 'ইরোটিক আর্ট'-এ | ওদের সমাজ কতটা কলুষিত ছিল এটাও জানা গিয়েছিল ওই আর্ট থেকেই | দুর্ভিক্ষের বর্ননায় এখনও জয়নুল আবেদীনের ছবি দেখি আমরা | বাংলার প্রকৃতিকে দেখি কামরুল হাসানের তুলির টানে | গ্রামের মাটির ঘ্রান পাওয়া যায় এস এম সুলতানের ক্যানভাসে | এখন বলো এগুলো মূল্যহীন ?"
মনজুরের মুখে কথা যোগালো না |
আলিজা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "ভাইয়া খেয়ে না তোরা | আর দোহাই লাগে আমার না খেয়ে উঠবিনা তোরা | আমরা পরে খাবো |"
আলিজা এরিককে আর বাকি সবাইকে নিয়ে চলে গেল |
আইলান কোন কথা না বলে খাওয়া শেষ করল | মনজুরের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল আগেই তাও সে বসেছিল |
আইলান উঠে দাঁড়াতে সে বলল, "দ্যাখ এখন তো বুঝবিনা তোরা কিন্তু পরে যখন টের পাবি তখন বলবি | ব্যাপারটা হল এই প্রথম থেকে ওরে............"
আইলান বাপকে কথা শেষ না করতে দিয়েই বলল, "বাবা প্লিজ ! দোহাই লাগে তোমার | এখন তুমি তোমার কোন উদ্ভট যুক্তি আমাকে শোনাবেনা | তোমার সব কথাই অথর্ব | দুচোখ কানা, দুকান কালা আর মুখ সেলাই করা যুক্তি সব | আমার মেয়ের বয়স মাত্র ছয় | অথচ এখনই আমি দেখি তুমি প্রায়ই ওর সাথে এর তার তুলনা দাও |"
মনজুর থতমত খেয়ে বলল, "কই ? কখন ?"
"আমি দেখেছি বাবা | সেদিন তুমি ওকে তোমার বন্ধু আকমলের নাতির সাথে তুলনা করে বলছিলে 'ওর মত হবি বুজছিস ওর মত হবি ! এরকম ভালোকরে পড়লে তবে জীবনে কিছু হতে পারবি |' এসব কি বাবা ?"
মনজুর হাসার চেষ্টা করে বললেন, "ঐটা বাচ্চাদের বলতে হয় | ওদের মনে জিদ তৈরী না করলে ওরা শিখবে কেমন করে ?"
"ওহ ঐরকম বলতে হয় ? যেমনটা তুমি আর মা আমাদের দুই ভাইবোনকে সবসময় বলতে ? তোমাদের মুখের ভাষাই ছিল 'ওদের মত হতে পারিস না !' আর আলিজাকে তো আরো খারাপ কথা বলতে | ওকে কথায় কথায় বলতে "অমুকের পা ধুয়ে পানি খা !" নইলে "ওর মেয়েকে দেখেছিস, ওর পায়ের নখের যোগ্যতা তোর নেই !" ছি ছি ছি !"
মনজুর এবার কোনরকমে বললেন, "ঐটা তো বাপমায়েরা বলেই ! ওটা বলার কারন কি ? বলে যাতে মনে জিদ তৈরী হয় |"
"হ্যা ঠিকই বলেছো ! আর জিদের সাথে ঘেন্নাও তৈরী হয় |"
আইলান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, "মাহি ওঠো | যাও ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো গিয়ে | আমি কথাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আসবো |"
মাহিরা উঠে চলে গেল ঘরে ধীরে ধীরে |
মনজুর বললেন, "এখন ভুল যদি বুঝিস তোরা তো কি বলার আছে !"
আইলান আক্ষেপের সাথে বলল, "বাবা ভুল বুঝছিনা | এই এখন ঠিক একেবারে সঠিক বুঝছি তোমাকে | বাবা যা করলে না তুমি এই কয়েকদিনে !"
"আমি কি করলাম |"
"মনে করে দ্যাখো কি করলে ! বাবা ও আসার পর তুমি যেমন ব্যবহার করেছিলে ওর সাথে আমার খুব আনন্দ হত তখন | ইস ! যা হয়নি কখনও তা হচ্ছে এখন | কখনও তুমি ভালো ব্যবহার করতেনা সেটা করছো এখন | একটা আলাদা খুশি লাগছিলো | এরপর কিছুদিন গেল আর আবার তুমি যেইকে সেই হয়ে গেলে ! কথায় কথায় দুর্ব্যবহার, অভদ্র কথাবার্তা, রাগারাগি, তাচ্ছিল্য, অপমান করা সব ফিরে আসলো | তুমি প্রথমে যা করছিলে সেটা হল অভিনয় | আর এখন যা করছো এটা হলে সত্যিকারের তুমি |"
আইলান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "দশবছর আগে আমাদের কারণেই চলে গিয়েছিল মনের কষ্টে | কারন আমরা ওকে ওর প্রাপ্য আদর, মায়া, ভালোবাসা কিছুই দেইনি | এরপর তিনবছর পর এলো তখনও ওকে ভয়ংকর কষ্ট দিয়েছো | ওর সাথে তুমি আর মা যে ব্যবহার করতে এরপর ওর জায়গায় অন্যকেউ হলে কোনদিন ফিরেও তাকাতোনা তোমাদের দিকে | অথচ মায়ের অসুখ শুনে এসে পড়েছিল | আসার সাথেসাথে তুমি ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলে মার সেবায় | প্লেন থেকে নেমে একটাদিন বিশ্রামেরও সময় ওকে দাওনি |"
মনজুর একপেশে হেসে বললেন, "এটাই তো ! এখানেই তো কথা ! এটাই তো জ্ঞানের অভাব |"
আইলান ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, "না নেই আমার জ্ঞান ! কোন জ্ঞান, বুদ্ধি, আক্কেল কিচ্ছু নেই আমার | তুমি হচ্ছো কেমন জানো ? তোমার আত্মীয়েরা যেমন, তোমার বন্ধুরা যেমন আর যাদের সাথে তুমি মেশো অবিকল তাদের মত ! স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, নির্দয়, বিবেকহীন !"
আলিজা আইলানের জোরে জোরে কথা বলা শুনে দ্রুত এসে দাঁড়ালো | আইলান বোনের দিকে চেয়ে বলল, "একটাও কথা বলবিনা তুই | আজকে আমার মুখ বন্ধ করবিনা | আমার অনেক সাহস জোগাড় করতে হয়েছে এই কথাগুলো বলার জন্য |"
আলিজা শুধু বলল, "জানিসই কোন ফল হবেনা এর |"
"না হোক ! বলবোই আজ |"
মনজুর বললেন, "এখন আমাকে যদি ভুল বুঝিস তোরা তো এটা তোদের ব্যাপার |"
"না | আমাদের ব্যাপার নয় | তুমি আর তোমার মত কয়েকজন সারাটাজীবন অন্যায় আর ভুলকে সঠিক মনে কর | তোমার বন্ধু বাদশা নিজের তিনটে মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল তাদের কোনরকম ভরনপোষন না করেই | মেয়েগুলো কোথায় থাকবে, কি করবে, কেমন করে চলবে এর ভাবনা সে করেনি | তিনজনই খুব কষ্টে কিছুদিন থেকে বিপথে চলে গেল | প্রথমজন এক বিবাহিত লোকের ঘর ভেঙে তাকে বিয়ে করল আর স্বামীর মাধ্যমে চাকরি পেল | দ্বিতীয়জন একটা ছেলেরসাথে চারবছর একসাথে থেকে পরে ওই ছেলেকে বিয়ে না করে ছেলেটার বন্ধুর সাথে প্রেম করে আমেরিকায় গেল | এই সেই যার সঙ্গে তুমি আলিজার পিএইচডি করা সময়ে আলিজার আর ওই মেয়ের তুলনা দিতে | মেয়েটা তোমাকে বলেছে সে ওখানকার ব্যাংকে বড় অফিসার | কিন্তু তুমি জানো ও আসলে কি করে ? ও তিনরকমের তিনটা ছোটকাজ করে | একটা ফুলের দোকানে ফুল আলাদা করে, একটা কফিশপে কাপ ধোয়, আর একটা রেস্টুরেন্টে মেঝে পরিস্কার করে | ওর পেশাকে আমি ছোট করছিনা বাবা | অথচ ওর সঙ্গে তুলনা করে তুমি নিজের মেয়েকে ছোট করতে সবসময় | এই কথাটা তোমার মাথায় আসেনি যে একটা অনার্স কলেজে পড়া মেয়ে টেনেটুনে সেকেন্ডক্লাস রেজাল্ট নিয়ে আমেরিকার ব্যাংকে সিনিয়ার অফিসার হয়না | কিন্তু ঐযে তোমার বন্ধু বলেছে ! বন্ধু কি মিথ্যা বলবে ! তুমি সবসময় পরের কথায় নাচানাচি করো | তোমার ওই বন্ধু এখন তোমাকে ফোন করে মেয়েদের সুনাম করে কারন তিন মেয়েই অনেকগুলো করে টাকা পাঠায় তাকে | আগে যেই মেয়েদের দেখতে পারতনা এখন তাদের সোনা আদরে রাখে ! কারন হল টাকা ! আরে থু দেয়া উচিত এমন বাপদের মুখে যাদের কারনে তাদের সন্তানেরা বিপথে যেতে বাধ্য হয় !"
মনজুর আমতা আমতা করে বলল, "এইটা শোনা কথা | কে কি করেছে সেটা চোখে না দেখে বলা যায়না |"
"তুমি তো তাই বলবে ! অন্যের কোন দোষ তুমি কোনদিনই দেখতে পাওনা | তুমি দ্যাখো শুধু আমার আর আলিজার দোষ | বন্ধুর মেয়ে প্রথমজীবনে প্রস্টিটিউশন করেছে সেটা তো কোনদিন তুমি বিশ্বাস করবে না |"
"এসব না বলাই ভালো |"
"বাহ্ ! ধন্য করলে ! বন্ধুর তিন মেয়ে প্রস্টিটিউট ছিল সেটা বলতে বাধো লাগে তোমার | অথচ দিনের পর দিন মা যখন কামরানকে খাওয়াতো তখন এই বাধো কই ছিল ? উত্তর দাও কই ছিল ?"
মনজুর হতবাক ! আইলানের এই চেহারা সে কোনদিন দেখেনি |
আইলান ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলল, "একবার কি মনে হয়েছিল তোমার যে এই লোকটা যে সবসময় তোমার মেয়ের দিকে নোংরা চোখে তাকায় তাকে যখন মা কাছে বসিয়ে ভাত বেড়ে খাওয়ায় তখন তোমার মেয়ের মনের ভেতরটায় কি অনুভুতিটা হত ? কি কষ্টটা ও পেত ? তোমরা নিজে কোনদিন জানোয়ারটার প্রতিবাদ করোনি আর আশ্চর্য হল ও কিছু বললে লজ্জায় অস্থির হয়ে যেতে ! কেমন করে করতে সেটা ?"
আলিজা ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, "থাম তো ভাইয়া ! যা ঘরে যা |"
আইলান যেন অন্যমানুষ আজ | সে বলল, "কয়টা দিন তুমি মনে করতে পারো যেদিন একটু ভালোকরে কথা বলেছো ? কয়টা দিন একটু ভালো আচরণ করেছো ? একটাদিন মনে করো তো যেদিন তুমি আমাকে আর আলিজাকে সাথে নিয়ে এমনিতে কোথাও ঘুরতে বেরিয়েছ ? একটাদিন মনে করো তো যেদিন তুমি আমাদের সাথে হেসে গল্প করেছো ? করোনি | কারন তুমি দুএকটা কথাতেই শুরু করতে অন্যের সাথে তুলনা | ও এটা করে, ও সেটা করে, ও ওটা পারে এই হল তোমার কথার নমুনা |"
মনজুর চুপ করে আছেন |
আইলান বলল, "তোমার গ্রামের বন্ধু মহসিনকে দেখেছি আমি | তার দুই ছেলেমেয়েকে সে সারাদিন প্রচার করে বেড়ায় আর সারাদিন মহসিনের বৌ বাচ্চাদুটোকে জোরকরে পড়তে বসিয়ে রাখত | গ্রামের বাড়ি যাবার পর একটা ঘটনা মনে পড়ে | তখন আলিজা অনেক ছোট | মহসিনের মেয়ে আলিজার সাথে গল্প করতে এসেছিল | দেখলাম কিছুক্ষন পরেই মহসিনের বৌ দৌড়ে এলো মেয়েকে নিয়ে যেতে | কারন আলিজা এতক্ষন ধরে মেয়েকে আটকে রেখেছে মেয়ের পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে ! সে আলিজাকে সরাসরি বলে বসল যেন আলিজা আর যেন কখনো ওর মেয়েকে এভাবে আটকে না রাখে | কত পড়া নষ্ট হল | তো এসব বাবামায়ের ছেলেমেয়েরা কেমন আর হবে ! মেয়েটাও দেখতাম সারাক্ষন শুধু পড়া পড়া করত | এরপর অনার্স পড়ার সময়ই ওর বাপ চাকরির জন্য পাগল হয়ে গেল | আর মেয়েটা প্রাইমারি স্কুলে ঢুকল | এই মেয়ের সাথে তুলনা দিয়ে তুমি এত আজেবাজে কথা আলিজাকে বলতে যে এখন ভাবতেও অবাক লাগে আমার যে কিকরে সহ্য করত ও ! ও যতখন না কাঁদত হাউমাউ করে ততক্ষন পর্যন্ত তুমি বলেই যেতে ! অথচ কই ওই মেয়ে আর আলিজার অবস্থান কই ! তুমি কি বললে তখন আলিজার দায়িত্ব ছিল মায়ের সেবা ! আচ্ছা ওর ওপর কোন দায়িত্বটা পালন করেছো তোমরা ? কিছুইনা ! জানি এখন কি বলবে তুমি ! বলবে যে তোদেরকে খাইয়েছি, পড়িয়েছি, থাকার জায়গা দিয়েছি | কিন্তু এগুলোই কি বাবামায়ের কর্তব্য না ? এটাই কি তাদের কাজ না ? কিন্তু ছোটবেলা থেকে ওই কুলাঙ্গার লোকগুলোকে দেখে দেখে তোমার এই ধারণা হয়ে গিয়েছে যে খাইয়ে পরিয়ে ধন্য হয়েছো তুমি আর আমাদের উদ্ধার করে ফেলেছো ! অথচ দায়িত্ব এটা তোমাদের কিন্তু সেটাকে তোমরা দান মনে করে নিয়েছো | আলিজার কোন ঠেকাই ছিলোনা এভাবে হাসপাতালে পড়ে থেকে অবশেষে মরতে বসা ! কিন্তু ও তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে হতে পারো তোমরা বাবামা কিন্তু তোমরা দায়িত্বহীন | তুমি যেমন সবসময় তেমন থাকবে | বদলানো অসম্ভব তোমার পক্ষে | তুমি পারবেনা বদলাতে | একটু পরিবর্তন হবে তোমার তখন আবার তোমার কোন পুরোনো বন্ধুর কি কোন আত্মীয়র দেখা পাবে, সে তোমার কোনপড়া দিয়ে মগজধোলাই করবে তখন তুমি আবার যেইকে সেই | আবার ওরকম হয়ে যাবে | আগেরমত বিচিত্র !"
আইলানের মেজাজ এত সহজে নামবেনা দেখে আলিজা বাপের দিকে চেয়ে বলল, "বাবা, ঘরে যাও | ভাইয়া যা বলে বলুক | আমার কোন অভিযোগ নেই তোমার উপর |"
আইলান বলল, "সাতবছর আগে এসে তোমার কাছে কষ্ট পেয়ে গিয়েছে | এরপর তিনবছর আগে এসেছিল তখনও খুব একটা ভালো আচরণ করোনি তুমি ওই সাত দিনে | শুধু অপমান করতে পারোনি নাতিকে দেখে | আর এই কয়েকদিনে তুমি যা করলে সেজন্য আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে | বাবা দশবছর আগে তখন ওর কেউ ছিলোনা বিদেশে | তাই ডাকতেই ছুটে এসেছিলো | আর এখন ওর এরিকের মত একজন স্বামী আছে যে ওর জন্য সব করতে প্রস্তুত | রজার আংকেলের মত শশুর আছে যিনি ওকে মেয়ের মত ভালোবাসে নিঃশর্তভাবে, এতটা যা তুমি সারাজীবন চেষ্টা করেও পারবে না | দুটো ফুটফুটে বাচ্চা আছে যাদের দেখলেই কলজে জুড়িয়ে যায় | আর ওখানে ওর একটা সুন্দর সাজানো-গোছানো সংসার আছে | ওর একটা নিজের জগৎ আছে ওখানে বাবা | ও সেই জগৎ ফেলে আর সহজে আসবে না | কারন এখন ও একা আর অসহায় না | ও চলে গেলে তোমার তো কিছুই না, কিন্তু আমার কি হবে সেটা শুধু আমি জানি | আর এবার যা করেছো আর করছো তুমি তাতে ও যদি চায়ও আসতে কিন্তু ওর স্বামী, শশুর, মেয়ে কেউই আর সহজে ওকে আসতে দেবে না | ওরা ওর মূল্য জানে | ওরা তোমার মত না |"

..................................................

মেঘের আলোয়Where stories live. Discover now