#১৪

437 15 0
                                    

#আলোছায়া
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৪

শহরে নেমেছে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের আলো যেন তাদের কাছে বড়ই ম্লান! যানজট পূর্ণ কলরবমূখর রাস্তায় পীড়াদায়ক চিন্তার খানিকটা অবসান ঘটাতে গাড়ির সিটে মাথা রেখে চোখজোড়া বুজলো উল্লাসী। আশেপাশে থেকে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চারপাশটা দৃষ্টি গোচর হলেও তার দৃষ্টিতে শুধুই ঘন আঁধার। নানাজানও তাহলে বুঝলো না তাকে? আর বাবা? তার তো নেই কোনো খোঁজখবরও। এক জীবনে এতটা কষ্ট নিয়ে বাকিটা পথ কীভাবে চলবে সে? বুকের ভেতরটায় চাপা কষ্টগুলো ফুঁসে উঠলেও চুপচাপ বসে রইলো উল্লাসী। সে তো জন্মদুঃখী.. এতিম। আপন বলতে তার কেউ নেই। তাহলে আজ কেনো আপনজনের সন্ধানে বেরিয়েছিল সে?
"ম্যাডাম, আইসা পড়ছি।"
ড্রাইভিং সিট থেকে আমজাদ আলী দাঁত বের করে কথাখানা বলে উঠতেই সোজা হয়ে বসলো উল্লাসী। বুকচিরে বেরিয়ে আসা গভীর এক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে গাড়ি ছেড়ে নামার তোড়জোড় করতেই আমজাদ আলী আবারও বললেন,
"স্যার কি আর বাড়াইবো? নাকি গাড়ি গ্যারেজে রাইখা আমি যামুগা?"
"না.. আপনি থাকুন এখানেই। আমি উপরে গিয়ে আপনাকে কল করে জানাচ্ছি।"
গম্ভীরমুখে গাড়ি ছেড়ে নেমে তাদের দালানের দিকে এগুলো উল্লাসী। অস্থির লাগছে তার। সোজা হয়ে হাটতে পারছেনা সে দু'কদম।

বিছানার মাঝখানটায় শরীর মেলে শুয়ে রয়েছে মেসবাহ। গায়ে নেই তার কোনো পোষাক। পাশেই বসে রয়েছে ইভানা। একহাতে সে মেসবাহর চুলে হাত বুলিয়ে দিলেও অপর হাত মেসবাহর লোমশ বুকে নিয়ে খেলছে খানিক বাদেবাদে। শোবার ঘরে ঢুকে এদৃশ্য দেখামাত্র শরীর রি রি করে উঠলো উল্লাসীর। মাথা উঠলো হালকা ঘুরে। এই ছিল মেসবাহর মনে? এই কারণই ছিল তবে তাকে বাড়ি থেকে বের করার পেছনে? শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল এক রক্তস্রোত বয়ে যেতেই ঘাড় শক্ত হয়ে এল উল্লাসীর। কোনো দিকবিদিক না ভেবেই চেঁচিয়ে মেয়েকে ডেকে উঠলো সে।
"মৈত্রী? এই মৈত্রী?"
খানিকক্ষণ আগেই মেসবাহর প্রেশার মেপে ঔষধ খাইয়ে দেয়ার পর বেশ কষ্টে ঘুমিয়েছে সে। তবে এরই মাঝে উল্লাসীর হঠাৎ আগমনে কিঞ্চিত বিস্মিত হলেও তার চেঁচামেচি শুনে তাকে টেনে পাশের ঘরে নিয়ে এল ইভানা। গলার স্বর নামিয়ে এনে উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বললো,
"কোথায় ছিলে তুমি? আর এসেই বা এভাবে চিৎকার কেনো করছো?"
ইভানার হাতের মাঝ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল উল্লাসী। ক্ষোভে ফেটে পড়ার মতো পরিস্থিতি হলেও নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নেয়ার চেষ্টায় সে বললো,
"আমার বাসা.. আমি চিৎকার করি আর যাই করি তা একান্তই আমার ইচ্ছে।"
"তোমার বাসা সেটা মাথায় আছে। অথচ স্বামীটা যে তোমার সেটা মাথায় নেই? উল্লাসী, হোয়াটস রং উইথ ইউ? কী হয়েছে তোমার?"
"কিছুই হয়নি। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছি।"
"আর ইউ ক্রেজি? তোমার স্বামী অসুস্থ। আর তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছো? তুমি মেসবাহকে নিয়ে কতটা উদাসীন সেটা জানো? তুমি তো দেখছি এখনো ঠিক আগের মতোই রয়েছো। না আছে তোমার মেসবাহকে নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা আর না সংসারের!"
আপনিও তো আগের মতোই আছেন। অন্যের স্বামীর দিকে না তাকালে মনই ভরেনা আপনার। মনে মনে কথাখানা আওড়ালেও মুখে কিছু বললো না উল্লাসী। ওপাশ থেকে ইভানা বিরক্তে ভ্রু কুঁচকে বললো,
"শুধু শরীরে বেড়ে উঠলেই হয় না উল্লাসী। তুমি কেনো তোমার স্বামীকে বোঝার চেষ্টা করো না? ও একজন ডাক্তার। সারাদিন নানান কাজের ভেতরে থাকে, চাপে থাকে। ব্যস্ত একটা লাইফ লিড করে। তারপরও কিন্তু ও তোমাদের দিকেও যথেষ্ট কেয়ারফুল। আর তুমি কিনা ওর এফর্টটা বুঝতেই চেষ্টা করো না। এখনো এভাবে অবুঝের মতো আচরণ করলে চলবে? তাছাড়া তুমি কি জানো তোমার কাজকর্মে ও কতটা স্ট্রেস ফিল করে? শান্তি পায় না.. কোনো কাজে ঠিকঠাক কনসেন্ট্রেট করতে পারেনা। কেনো এভাবে ওর জীবনটাকে জটিল করে তুলছো তুমি?"
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। অবিশ্বাসের সঙ্গে বললো,
"এসব আপনাকে উনি বলেছেন?"
"সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা তুমি বড় হয়েছো। মেসবাহর বয়স বেড়েছে। ওর শরীরের দিকটা নিয়ে তুমি না ভাবলে আর কে ভাববে? নাকি তুমি ডোন্ড কেয়ার ভাব নিয়ে চলে চৈতালির অবস্থানে যাও?"
ইভানার প্রশ্নের উত্তরে লম্বা একটি দম ছেড়ে শোবার ঘরের দিকে এগুলো উল্লাসী। আলমারি থেকে মৈত্রীর কিছু জামা বের করে টেবিল থেকে নিজের বইখাতা গুলো ব্যাগে ভরে সে খুব সন্তর্পণে একবার তাকালো মেসবাহর দিকে। লোকটি কি সত্যিই অসুস্থ? নাকি অসুস্থতার বাহানা দেখিয়ে ইভানার সাথে শরীরে শরীর ঘেঁষাঘেঁষিতে ব্যস্ত? নিজের মনে চলা প্রশ্নেত্তরের খেলায় নিজেকে বেশ ছোট মনে হলো উল্লাসীর। তবে ইভানার বলা শেষ কথাটিও তো ফেলনা নয়! সেও জানে চৈতালির স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে। অথচ সেই ব্যাপারে তাকে একবারও নিজে থেকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি মেসবাহ। সেদিন মৌমি তাকে না জানালে হয়তো তার অসুস্থতার মতো সবুজ স্যারের মৃত্যুর খবরটিও শুনতে হতো ইভানা নামক অসহ্যকর এই প্রাণীটির কাছ থেকে।

আলোছায়া Where stories live. Discover now