6 0 0
                                    


লোকটা বাচ্চাটাকে নিয়ে গেল শহরে ওর বাড়িতে। ওর বাড়ির ছাদে সারি সারি অনেক খাঁচা। তাতে নানা পশু পাখি। লোকটা জঙ্গলে গিয়ে কোনও প্রাণী বা পাখি জীবন্ত পেলে ধরে নিয়ে আসত, খাঁচায় রাখত, কিন্তু দেখাশোনা করত না।

কৃষ্ণসারেরও ওই দশা হল। লোকটা ওকে একটা খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। চাকরদের বলল খেতে দিতে। চাকররা জানত বাবু আর ওকে দেখতেও আসবে না। ফলে ওরাও ভালো করে দেখাশোনা করতো না।

দিন কাটে, বাচ্চাটা খেতে পায় সামান্য, বাড়ে না ভাল করে। কিন্তু তাও দেখতে দেখতে খাঁচাটার চেয়ে বড়ো হয়ে গেল। আর হাঁটতে চলতে পারে না ওটার মধ্যে। আর কিছু দিন পরে দাঁড়াতেও পারে না। বসে বসেই খায়, বসে বসেই হিসি করতে হয়। কেউ পরিষ্কার করতে আসে না। লোমে, চামড়ায় নোংরা মাখামাখি হতে থাকে। চামড়ায় অসুখ হয়। লোম খসে পড়ে, চামড়া থেকে রক্ত ঝরে। কেউ মাথাই ঘামায় না। চাকররাও না, আর লোকটাও নয়। বাচ্চাটা বসে বসে ভাবে, এবার ও-ও বুঝি ওর মায়ের মত একদিন মরেই যাবে।

কিন্তু মরল না। এক দিন ভোরবেলা, তখনও বাড়িতে কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি, অনেক লোক এসে দরজায় ধাক্কা দিল। ওরা কেউ বনদপ্তরের অফিসার। কেউ বা পুলিশ। পাশের বাড়ির একটা ছেলে দেখেছিল এ বাড়ির ছাদে অনেকগুলো খাঁচা, তাতে সারি সারি বন্যপ্রাণী। ছেলেটা জানত যে সেটা বে-আইনি। তাই ফোন করে বনদপ্তরকে জানিয়েছিল ওদের কথা।

কাজের লোক দরজা খুলল।

পুলিশ বলল, "তোমার বাবু কোথায়?"

চাকর ভয়ে পেয়ে বলল, "বাবু ঘুমোচ্ছে।"

পুলিশ বলল, "ডাকো তাকে।"

লোকটা এল, চোখে ঘুম, চুল উস্কোখুস্কো। পুলিশ জিজ্ঞেস করল, "আপনার বাড়িতে বন্যপ্রাণী আছে?"

লোকটা মিথ্যে করে বলল, "কী? না, না! কই, না তো!"

বনদপ্তরের অফিসার বলল, "আমরা খুঁজে দেখব।"

লোকটা এবার আরও ভয় পেল। বলল, "না না, তার দরকার নেই। আমি বলছি তো, কোনও বন্যপ্রাণী-টানি কিচ্ছু নেই।"

পুলিশ বলল, "তবু আমরা খুঁজে দেখব। আপনিও আসুন আমাদের সঙ্গে। নইলে যদি পালিয়ে যান!"

বাধ্য হয়ে লোকটা গেল পুলিশের সঙ্গে। বলল, "আমি দাঁত মেজে আসি?"

পুলিশ মাথা নাড়ল। দাঁতও মাজতে দিল না।

সব ঘর ঘোরা হয়ে গেলে লোকটা বলল, "দেখলেন? কিছুই নেই।"

পুলিশ বলল, "ওই সিঁড়ির ওপরে কী?"

লোকটা বলল, "কিছুই না। শুধু চিলেকোঠা, আর ছাদ। ওখানে গিয়ে লাভ নেই।"

বনদপ্তরের অফিসার বলল, "লাভ আছে বইকি! সারা বাড়িই খুঁজতে হবে না?"

এই শুনে লোকটা বুঝল আর লাভ নেই। পুলিশ ছাদের দরজা খুললেই সব ধরা পড়ে যাবে। এক লাফে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালালো। কিন্তু সিঁড়ির নিচে আরও অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। খপ্‌ করে ধরে ফেলল ওকে।

পুলিশ বলল, "তার মানেই ছাদে কিছু আছে। চল, দেখা যাক।"

ছাদের দরজা খুলেই দেখা গেল এক ভয়ানক দৃশ্য।

সারি সারি খাঁচা। তাতে অসুস্থ, প্রায় মরে যাওয়া সব প্রাণী। কৃষ্ণসারের বাচ্চাটাও তাদের মধ্যে রয়েছে। এতই দুর্বল, এতই অসুস্থ, যে বেঁচে আছে না মরে গেছে বোঝাই যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ ধরে দেখে তবে বনদপ্তরের অফিসাররা বুঝল, না —বেঁচে আছে, নিঃশ্বাস পড়ছে।

খাঁচা খুলে খুলে সবকটা পশু পাখিকে বের করল অফিসাররা। সব্বাই অসুস্থ, দুর্বল। বাড়ির সবাইকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। লোকটাকে নিয়ে গেল বন্যপ্রাণীদের খাঁচায় বন্দী করে রাখার জন্য। ওর চাকরবাকরদের নিয়ে গেল প্রাণীদের দেখাশোনা না করার জন্য। বাড়ির অন্য সবাইকে নিয়ে গেল ওদের সাহায্য করার জন্য। আর ওই পাশের বাড়ির সাহসী ছেলেটা, যে বনদপ্তরকে খবর দিয়েছিল, তাকে পুরষ্কার দিল ওরা।

সব অসুস্থ জীবগুলোকে ওরা নিয়ে গেল পশু হাসপাতালে। সেখানে পশুপাখিদের জন্য ডাক্তার রয়েছে — তাদের বলে ভেটেরিনারি ডাক্তার। তারা দেখেই বুঝতে পারে পশুপাখিদের কোথায় কষ্ট হচ্ছে। ওরা তো মানুষের মতো বলতে পারে না, কোথায় ব্যথা করছে!

কৃষ্ণসারের অবস্থা শোচনীয়। তার মানে খুবই খারাপ। বহু দিন দাঁড়াতে না পেরে ওর পা একেবারে দুর্বল হয়ে গেছে। উঠতে গেলেই থরথর করে কাঁপে, আবার বসে পড়তে হয়। সারা গায়ে ঘা, তা থেকে রক্ত পড়ছে। গোছা গোছা লোম খসে খসে পড়ছে। ভেটেরিনারি ডাক্তার দেখে ভীষণ রেগে গেল। বলল, "এমন নিষ্ঠুর মানুষের ভীষণ সাজা হওয়া উচিত।"

লোকটাকে পুলিশ আদালতে নিয়ে গেল। কোর্টে বসে বিচারপতি সব শুনলেন। বললেন, "আমি দেখতে যাব ওই প্রাণীগুলো।" উনি নিজে এলেন পশু হাসপাতাল। দেখে শুনে এমন রেগে গেলেন, যে লোকটাকে অনেক দিনের জন্য জেলে পাঠালেন। বললেন, "ওকে কঠিন কাজ দিতে হবে, যাতে ওর শিক্ষা হয়।"

দুষ্টু কৃষ্ণসারWhere stories live. Discover now