কাঁটায় কাঁটায় রাত ন'টা ।দূরের কৃষ্ণনগর ক্যাথিড্র্যাল চার্চের ঘন্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।পঞ্চম লেন পাড়ার কোনো বাড়িতেই এখনও আলো নেভেনি।প্রতিদিনের মতোই দশ পা দূরত্বের সম্রাট ক্লাবটায় দশ-বারোজন আড্ডা দিচ্ছে।আমি নিজের খাওয়ারের তোড়জোড় করছি।বাড়িতে আমি একাই আছি।সকালবেলাতেই মাসী আর দাদু কোনো কাজে বেরিয়েছেন।কী কাজে সেটা অবশ্য আমাকে বলেননি।মাসী আমাকে বার বার বলে দিয়েছেন আমি কোনোসময় যেন পেটে খিদে নিয়ে না থাকি।সকালেই মাসী ভাত-মাছ রান্না করে দিয়েছিলেন যেটা দুপুরের খাবার হিসাবে চলে গিয়েছে।এখন রাতে আমাকে নিজের মতো রুটি করে নিতে হবে।সামান্য মাছ আছে,তা দিয়েই আজকের রাতটা চলে যাবে।আর কাল সকালে মাসী-দাদু তো চলেই আসছেন।
এখন আমি আটা মাখছি।গ্রিলটাতে আংঠা লাগিয়ে দিয়েছি।আটা মাখা প্রায় হয়ে এসেছে।এমন সময় উঠোনের সামনে কাউকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।চুপচাপ কিন্তু অদ্ভুতভাবে মাথাটা নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সম্ভবতঃ নিজের পায়ের দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।রাস্তায় আলো জ্বললেও অঞ্জাতটি মাথা নিচু করে আছে বলে ঠিকমতো বুঝতে পারছি না।আমি মাখা আটার বাটিটা পাশে সরিয়ে রেখে উঠে গেলাম।আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে গ্রিলের আংঠাটা খুললাম।আশ্চর্য!অঞ্জাতটি এখনও সেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে । কোনো মহিলাই হবে। আরেকটু এগোতেই বিকট্ পচা গন্ধ আমার নাকে ভেসে এল। আমি আর এগোতে পারলাম না। নাক টিপে পিছিয়ে এলাম। তবে আমি কোনো কথা বললাম না। ও যেমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ তাকালে মনে হতে পারে কেউ মূর্তি গড়ে উঠোনে ষ্ট্যান্ড করিয়ে রেখে দিয়েছে। আমিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম। পাশ থেকে রাস্তার লাইটের আলোটা পড়লেও মুখটা এমনভাবে নীচের দিকে ঝোঁকানো আছে যে ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। আমি মিনিটকয়েক এভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কেন জানি না। সত্যি কথা বলতে কি একটা অস্বস্তিভাব মনের মধ্যে কাজ করছে। এতরাতে এমনভাবে কেউ..... হঠাৎ সামনের রাস্তা দিয়ে একটা মোটরসাইকেল তীব্রবেগে চলে গেল। আর তার জোরালো আলো এসে আগন্তুকের একপাশটা একমূহুর্তের জন্য জোরালোভাবে আলোকিত করে গেল। আর কিছুটা অস্পষ্ট হলেও মুখটাকে দেখে হঠাৎ যেন খুব চেনা চেনা ঠেকলো।
সম্ভবত একারণেই মনে সামান্য একটু বল এল। আমি ডানপকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরে আস্তে আস্তে ওর দিকে এগোতে লাগলাম। ওয়াক্! নাকে কষে রুমাল চাপা দিয়েও গন্ধটাকে এড়ানো যাচ্ছে না। হঠাৎ আগন্তুকটি মাথা উঁচু করল! হয়তো আমাকে এগোতে দেখেই..... আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কেননা মাত্র কয়েক হাতের মধ্যেই দাঁড়ানো আগন্তুকটির মুখ এখন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
"মা!!" মনের মধ্যে যেন একটা আবছা আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল,"কতদিন বাদে!"
কিন্তু মা কোনো কথা বললেন না! আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। পরণে ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত শাড়ি-ব্লাউজ। যার আসল রঙ চেনা দুস্কর! সারা শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসছে। সম্ভবত অনেকদিন মা স্নান করেন নি। যেমনটা প্রায় এগারোমাস আগে দেখেছিলাম, ঠিক তার উল্টোটা! মায়ের শরীর আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। মা মোটা আর কত ফর্সা ছিলেন, মুখটাও দেখতে অনেক সুন্দর লাগত। আজ সবই পাল্টে গিয়েছে। মা অসম্ভবরকম রোগা আর খুব কালো হয়ে গিয়েছেন। এই মাকে আর আমাকে পাশাপাশি রাখলে কোনো অচেনা ব্যক্তি কল্পনাতেও আনতে পারবেন না যে আমি ওনারই ছেলে।
আমি আবার বললাম,"এতদিন কোথায় ছিলে?তুমি ঠিক আছো তো?"
এবারও মায়ের কোনো নড়াচড়া দেখলাম না।
কিন্তু এখন আমি কি করব? মাকে এভাবে বাইরে দাঁড় করিয়েও রাখা যায় না! এই অবস্থায় যদি অন্য কেউ দেখে ফেলে!
"মা ঘরে এসো", আমি বললাম। কোনো জবাব যে পাওয়া যাবে না জানতাম , তাই হল। মায়ের কোনো পরিবর্তন নেই।
না! এভাবে সম্ভব নয়, কিন্তু আমাকে কিছু তো একটা করতে হবে , আমি মাকে ঘরে ঢোকার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু মা যেন শুনতেই পেলেন না। আর আমি কি করব?নাকটা ভালো করে ঢেকে নিলাম। তারপর এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাতটা ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠলাম। এত ঠান্ডা! একটা জ্যান্ত মানুষের গা এত ঠান্ডা! আমি হাত ধরে টানলাম। কিন্তু মাকে টানতে পারলাম না। মা আমার তুলনায় অনেক ভারী! এবার অন্য হাতটাও লাগাতে হল।
প্রায় জোর করে মাকে ঘরে ঢোকালাম। মাসী-দাদু থাকলে হয়তো এমন করে ঘরে ঢোকাতে পারতাম না। মায়ের এই ডাষ্টবিনের বেশে ঘরে ঢোকাটাই অনুচিত। কিন্ত আমি মাকে ঘরে ঢোকালাম। বারান্দায় পা রাখার পর অবশ্য মাকে কোনো জোর করতে হল না। আসলে আমারই বেশিক্ষন মায়ের হাত চেপে ধরে থাকতে ভালো লাগছিলো না। হাতটা অসম্ভব ঠান্ডা। সম্ভবত অসুস্ততার কারণেই। বারান্দায় পা দিয়ে মা প্রায় নিজেই ঘরে ঢুকে গেলেন। তারপর দরজার পিছনে ধপ্ করে বসে পড়লেন। মাকে খুব বিধ্বস্ত লাগছে। আমি বারান্দা থেকে একটা জলের বোতল মাকে ধরিয়ে দিলাম। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। এখনও আমি বাঁ হাত দিয়ে রুমালটা নাকে মুখে চেপে ধরে আছি। এবার সেটাকে ছাড়লাম। দরজাটা বন্ধ করায় আর গন্ধ আসছে না। ওফ! কী দুর্গন্ধ! ঠিক করলাম আজকে সারা রাতটা বারান্দায় যেমন করে হোক কাটিয়ে দেব। তারপর কাল সকালে মাসী-দাদু ফিরলে মায়ের কোনো ব্যবস্থা করবেন। মা আপাতত সারা রাত ঘরের মধ্যে থাক। এইভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি আবার রুটি তৈরিতে মন দিলাম।
পাঁচ মিনিট কাটল। আমি রুটি বেলছি। হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে গোঙানির শব্দ ভেসে এলো। চমকে উঠলাম, মা গোনাচ্ছেন! আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজাটা ঠেলে পাল্লাদুটো দুপাশে ছাড়িয়ে দিলাম। মা উবু হয়ে বসে আছেন। মাথাটা দু'হাঁটুর মাঝখানে গোঁজা, সামান্য দুলছেন আর মুখ থেকে গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। বাঁ হাতটা নাকে টিপে আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,"মা!কিছু অসুবিধা হচ্ছে?"
VOCÊ ESTÁ LENDO
Dark Light
Fantasiaবাবলুর জীবটাই রহস্যে ভরা।খুব ছোট্টবেলায়, মাত্র চার বছর বয়সে যখন নিজের বাবাকে খুব খারাপভাবে হারালো, সেটাও একটা গভীর রহস্য ।গত বারো বছর ধরে একমাত্র বাবলু ছাড়া আর কেউই তা জানে না।আর সবার কাছেই এটা একটা রহস্য, বাবলুর বাবার মতো একজন সাধাসিধে, সর্বদা শান...