#এটি_একটি_কাল্পনিক_আত্মকথন
ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা সর্বস্ব মায়েদের আমি পছন্দ করি না৷
আমার নিজের কথা বলি। আমার শৈশব কেটেছে ভয়াবহ ট্রমার মধ্য দিয়ে। আমার স্মৃতি তৈরি হবার বয়সটুকু থেকে আমি জানি, আমায় খুব ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে৷ ক্লাসে ফার্স্ট হবার বাইরে আমার আর কিছু হওয়ার নেই।আমার মায়ের পেশা শিক্ষকতা। একজন শিক্ষকের সন্তান হিসেবে আমার ঘাড়ে যেন পড়াশোনার একটা অদৃশ্য পাথর চেপে গিয়েছিল, যে পাথর কখনো গড়িয়ে পড়ে না। অদৃশ্য শক্ত আঠা লেগে থাকে পাথরের তলায়। সেই পাথরের ওজন এত বেশি যে আমি ঘাড় সোজা করতে পারতাম না কখনোই। ঘাড় সোজা করতে গেলেই সেই পাথরের ভার আমায় টেনে ধরতো। অথচ আমার মাথা উঁচু করবার কথা ছিল। দৌড়ে শিমুলতলায় যাবার কথা ছিল। মাকড়সার জালে আটকানো ফড়িং ছাড়িয়ে দেবার কথা ছিল। আকাশে সাদা তুলোর মতো, সাবানের ফেনার মতো মেঘের দিকে তাকিয়ে ছুটে ছুটে দিগন্তে পৌঁছবার কথা ছিল। আমার অনেক কিছু করার কথা ছিল!
মায়ের পেশার সুবাদে অন্যান্য শিক্ষকেরা আমায় চেনেন। আমার মায়ের সাথে দেখা হলেই তাদের জানা চাই,
—তুলিকার কী খবর? ও পড়াশোনায় ভালো করছে তো?
আমার মা গর্বে বুক ফুলিয়ে বলতেন,
—এই তো টেন্স শেষ করলো গতমাসে।
সাথের শিক্ষকের চোখ তখন কপালে।
—ও মা, টু তে উঠেই টেন্স! আচ্ছা মামণি বলোতো দেখি, স্কুল যাবার আগে আমি ছবি আঁকছিলাম। এর ইংরেজি কী?
আমি মিনমিন করে বলি,
—আই হ্যাভ বিন ড্রয়িং পিকচার বিফোর আই হ্যাড গান টু দ্য স্কুল।
—এটা কোন টেন্স মামণি?
আমার গলার স্বর থেমে আসে। ভেতরে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে আমি নিশ্চিত জানা উত্তর দিই।
–পাস্ট পারফেক্ট কন্টিনিউয়াস টেন্স।
বলবার সময়ে ভয়ে আমার প্রাণ বেরোয়।
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকাই। মায়ের তখন প্রাণ হাতেই থাকে না। যতটা না আমার জন্য ভয় করে তার থেকে বেশি ভয় করে আমার মায়ের জন্য।
টেন্স ভুল করলেই মা মরে যাবেন। লজ্জায় মরে যাবেন।
আমার মায়ের জীবন আর বেঁচে থাকা আমার ওই টেন্স বলতে পারার কাছেই।
উত্তর ঠিক হয়। সামনের মানুষটা হেসে উঠে মায়ের কাছে আমার প্রশংসা করে। মা'কে বলে
—বাহ! মেয়ে তো অনেক এগিয়ে গেল।
মা এটা তেমন কিছুই নয় আমার মেয়ের জন্য এমন টাইপ হাসি হাসেন। বিনয়ে, গর্বে মিশে মায়ের হাসি শতবার করে বলে, আমার মেয়ে এর থেকে অনেক বেশিই পারে। তুমি তো খুব সোজা প্রশ্নটা করেছো।
সামনের স্যার মায়ের সেই ভালো হাসিকে মেনে নিতে পারে না বোধহয়। আগুন একটু উসকে দেওয়া বাতাস বইয়ে দিয়ে বলে,
—আপা তুলিকাকে কিন্তু বৃত্তি পরীক্ষাটা অবশ্যই দেওয়াবেন। ক্লাস থ্রি থেকে বৃত্তি দেওয়ার অভ্যাস হোক। ফাইভে গেলে আর সমস্যা হবে না। বৃত্তি না পাক, সাহস তো হলো!
মায়ের ভেতরকার গর্ব ভরা স্বপ্নের আগুন দাউদাউ করে উঠে। মা আমার হাত শক্ত করে ধরেন। যার ভাষা বলে, মেয়ে তো আমার বৃত্তি পাবেই পাবে। আমার মেয়ে তো সব পারে। মা মুখে বলেন,
–দোয়া করবেন তুলিকার জন্য।
আমার বুকের ভেতর প্রাণ তখন ছটফট করে। মায়ের জন্য। বৃত্তি পরীক্ষায় না বসলে হয়তো মা আবার প্রাণ হারাবেন। বৃত্তি না পেলে হয়তো মায়ের হারানো প্রাণটাও আবার হারাবে৷ বিশ্বাস করুন ঠিক ওইটুকু বয়স থেকে পড়াশোনার ভয় আর ভালো রেজাল্টের দুশ্চিন্তা আমার নিত্যসঙ্গী হয়ে গেল।
এদিকে আমার মায়ের তখন অন্য হিসেব নিকেশ। আর ঠিক কতটুকু পড়াশোনা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে আমার ভবিষ্যত আলোকিত হবে সেই দুশ্চিন্তা।
পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। কোনো বিকল্প থাকতেই পারে না। থাকলেও সেটা মিথ্যে কথা।