মেঘের আলোয়

Autorstwa Bangla_story

35.5K 1.4K 144

লেখিকা - রুবাইয়াৎ তৃণা . একটি জীবন সংগ্রামের গল্প বড় উপন্যাস Więcej

পর্ব : ১
পর্ব ২
পর্ব ৩
পর্ব ৪
পর্ব ৫
পর্ব ৬
পর্ব ৭
পর্ব ৮
পর্ব ৯
পর্ব ১০
পর্ব ১১
পর্ব ১২
পর্ব ১৩
পর্ব ১৪
পর্ব ১৫
পর্ব ১৬
পর্ব ১৭
পর্ব ১৮
পর্ব ১৯
পর্ব ২০
পর্ব ২১
পর্ব ২২
পর্ব ২৩
পর্ব ২৪
পর্ব ২৫
পর্ব ২৬
পর্ব ২৭
পর্ব ২৮
পর্ব ২৯
পর্ব ৩০
পর্ব ৩১
পর্ব ৩২
পর্ব ৩৩
পর্ব ৩৫
পর্ব ৩৬
পর্ব ৩৭
পর্ব ৩৮
পর্ব ৩৯
পর্ব ৪০
পর্ব ৪১
পর্ব ৪২
পর্ব ৪৩
পর্ব ৪৪
পর্ব ৪৫
পর্ব ৪৬
পর্ব ৪৭
পর্ব ৪৮
পর্ব ৪৯
পর্ব ৫০

পর্ব ৩৪

848 33 3
Autorstwa Bangla_story

আলিজা জোর করে এরিকের হাত ছাড়িয়ে বলল, "তুমি এমন কেন !"

এরিক বলল, "প্রথম থেকেই তুমি জানো ! আমি এমনই |"

আলিজা ঘুরে দাঁড়াতেই এরিক আবার পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল দুহাতে, বলল, "আমার জানতে ইচ্ছা করে তুমি এমন কেন ! তুমি বাধা দিলে আমার আরো বেশি তোমাকে আদর করতে ইচ্ছা করে !"

আলিজা অস্বস্তির সাথে বলল, "ছি এরিক ! ভাইয়ার সামনে এসব কি বলছো তুমি ! তোমার একটুও সংকোচ নেই |"

"না নেই !"

আলিজা ব্যস্তভাবে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল, বলল, "ছাড়ো তো ! আমার শাড়ির ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে |"

"লিজ ধস্তাধস্তি করে লাভ নেই কিন্তু | আমি না ছাড়লে তুমি যেতে পারবে না !"

আলিজা হাল ছেড়ে দিল, এরিকের জোরের সাথে তার পেরে ওঠা সম্ভবও না |

আইলান সিগারেট ধরিয়ে বলল, "আচ্ছা আমরা তিনজনেই তো উপরে চলে এলাম ওদিকে বাচ্চাদের দেখবে কে ? এরিক ম্যাডিসন কই ? ওকে সাবধানে রেখে এসেছো তো ?"

এরিক আলিজার খোঁপায় নাক ঘষে বলল, "ব্রিটিশ লেইডির কাছে বসে আছে ও ! তাছাড়া ড্যাড আছে আর তোমার বাবাও আছে |"

আইলান সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, "বাহ্ ! বাপকে বেবীসিটার বানিয়ে তুমি এখানে এসে রোমান্স করছো ! আর নিচে গেলে সবাই দুষবে আমার বোনকে !"

এরিক আলিজার মাথার উপর থুতনিটা রেখে বলল, "তুমি আমার ড্যাডকে জানোনা এলান ! সে খুব ভালো একজন 'ম্যানি' !"

আলিজা এরিকের হাতের উপর চাপড় দিয়ে বলল, "এরিক ! তুমি ড্যাডকে ম্যানি বলছো ?"

আইলান অবাক হয়ে বলল, "ম্যানি কি ?"

এরিক বলল, "ন্যানির ( শিশুপালনকারিণী ধাত্রী ) পুরুষ ভার্সন হল ম্যানি !"

আলিজা আবার প্রতিবাদের সাথে বলল, "এরিক ! কি কথাবার্তা এসব !"

এরিক বলল, "সুইটহার্ট ড্যাড কিন্তু সত্যিই বাচ্চাদের সঙ্গে চমৎকার !"

"আমি জানি | কিন্তু উনি তোমার বাবা, আমারও বাবার মত আর আর আমার ছেলেমেদের দাদা ! তুমি তাকে ম্যানি কেন বলছো !"

"ওকেই মাই সোয়ান ( রাজহংসী ) ! আর বলবোনা !"

আলিজা সাদা পোশাক পড়লেই এরিক তাকে রাজহংসী ডাকে !

আলিজা এরিকের গালে আলতোকরে টোকা দিয়ে বলল, "ধন্যবাদ ডিয়ার হাসবেন্ড !"

"এজন্যই ড্যাড তোমাকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে |"

এরিকের সাথে তার বাবা রজারের বারো বছরের পুরোনো মনোমালিন্য আলিজা তার সাথে এরিকের বিয়ের পর মিটিয়ে দুজনের সমঝোতা করে দিয়েছে |

রজার সত্যিই তার তিন পুত্রবধূর মধ্যে আলিজাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন | তার কাছে সে তার মেয়ে নিনার চেয়ে কিছু কম নয় | রজার এখন এরিকের সাথেই থাকে | এরিকের মেয়ে ম্যাডিসন আর ছেলে এইব্রাহামকে সে দেখাশোনা করে | রজার বয়েসেই শুধু বৃদ্ধ কিন্তু শারীরিকভাবে সে শক্তসমর্থ আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী | তার প্রাক্তন সামরিক জীবন আর রণশৈলী প্রশিক্ষণ এর কারন | রজার থাকায় এরিক খুবই নিশ্চিত | কেননা এরিক বাইরে থাকলে তাকে চিন্তিত থাকতে হত আগে আর এখন রজার দেখে রাখে তার পরিবারকে | রজার খুব ভালো মার্কসম্যান আর সে মার্শাল আর্টে ব্ল্যাকবেল্ট | কাজেই রজারের উপস্থিতিতে কোন ক্ষতিই তার লিজ, ম্যাডি বা এইবের কেউ করতে পারবেনা |

রজার এখন ধীরস্থির গৃহী | সে বাগান করে, একটা বিড়াল আর কুকুর পালে দুটো | ২৬টা খরগোশ, গিনিপিগ, চিনচিলা ও একটা এলপাকা পালে | সমস্যা হল বাংলাদেশে এসে তার কালো ছাগল খুবই পছন্দ হয়েছে ! সে একজোড়া নিয়ে যেতে চায় | কি সুন্দর মিশকালো লোমশ প্রাণী আর কত ভালো পোষ মানে ! তার ধারণা এরা খুবই ভালো থাকবে তার কাছে | নিতে চাইলেও পারছেননা কারন এরিক দেবেনা নিতে |

এরিক তাকে জানিয়েছে, "বাবা আমার ঘর ওটা, চিড়িয়াখানা না যে তুমি এসব পশু দিয়ে ভরিয়ে ফেলছো !"

এখনও রজার আশায় আছে যে আলিজা হয়ত রাজি করবে এরিককে | রজারের ধারণা 'এলিজ' তার ড্যাডকে নিরাশ করবেনা হয়ত !

আইলান আরেকটা সিগারেট ধারালো |

আলিজা বলল, "ভাইয়া এখন নিচে যাওয়া দরকার | অনেকক্ষন হল ভাবি একা বসে আছে |"

আইলান বলল, "হুমম | এইতো লক্ষ্মী | আর পাঁচমিনিট পরেই নামব |"

আইলান মাহিরা অন্তঃসত্বা হবার পর থেকে কখনোই তার সামনে সিগারেট খায়না | এমনকি যখন প্রথমবার মাহিরা যখন গর্ভিনী হয়েছিল তখনও | তার মেয়ের নামটা আলিজারই রাখা |

এরিক চারিদিকে চেয়ে বলল, "এই জায়গাটা এত পছন্দের কেন তোমাদের দুজনের ?"

আইলান বলল, "একসময় এটা আমাদের খুব প্রিয় একটা স্থান ছিল | সুখদুঃখের আসর ছিল | এখন আর জায়গাটা আগেরমত নেই | সবই বদলায় এরিক |"

"হুমম | বুঝলাম |"

নাহিদের মেয়ে শিপ্রা উঠে এলো সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত | সে এসেছে মূলত এরিককে দেখে | আগে সে আইলানকে দেখে ছো ছো করত কিন্তু আজ আলিজা আপুর স্বামী এই অতি সুপুরুষ ভগ্নিপতিকে দেখে সে তার সঙ্গে বন্ধুত্বে খুবই আগ্রহী | কিন্তু ব্যাপারটা হল এরিক তাকে পাত্তাই দিচ্ছেনা ! সে অনেক ভিনভিন করেছে মাছির মত কিন্তু এরিক দুএকটা কথা বলে এড়িয়ে চলে গিয়েছে |

শিপ্রা উঠে এসে বলল, "আপনারা সবাই এখানে ! ওহ ! খুজতেসে নিচে সবে |"

আইলান একমুখ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, "কে খুঁজছে ?"

শিপ্রা তড়িঘড়ি বলল, "আপনার আব্বা |"

"বাবা আমাকে খুঁজবে কেন ?"

"ওই অনেকে আসে যে তাই !"

এরিক শিপ্রাকে দেখে কোন ভ্রুক্ষেপই করলনা, সে আগের মতোই আলিজাকে ধরে দাঁড়িয়ে রইল | বরং আলিজার মনে হল এরিকের হাতের বাঁধন আরো শক্ত হয়ে গিয়েছে |

আলিজা বলল, "এরিক আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছিনা !"

"যেতে দিলে তো !"

আলিজা অসহায়ভাবে বলল, "তোমাকে কিছু বলা অর্থহীন !"

শিপ্রা তাদের এভাবে দেখে চুপচাপ নেমে এলো |

আইলানের সিগারেট শেষ হলে সে ফিল্টারটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে বলল, "বানি চল নামি এবার !"

এরিক এতক্ষনে তার হাত সরিয়ে নিয়ে আলিজাকে ছাড়ল |

এরিক সরতে গেল তখনই আলিজা "উহঃ ! লাগছে !" বলে উঠল |

এরিক আর আইলান একসাথে বলে উঠল, "কি হয়েছে ? কোথায় লাগল ?"

এরিক দ্রুত আলিজাকে ধরে বলল, "লিজ কিহয়েছে ? এই তোমার লাগেনিতো ?"

আলিজা বলল, "তুমি দাঁড়াও এরিক ! আমার চুল আটকে গিয়েছে তোমার পোশাকে !"

এরিক দেখল তার পাঞ্জাবির চেনবোতামে আলিজার খোঁপার চুল আটকে গিয়েছে |

আলিজা বলল, "এরিক খোঁপার কাঁটাগুলো খুলে ফেলো |"

আলিজার একটা একটা চুল ছাড়িয়ে এরিক বলল, "স্যরি লিজ ! আমি খেয়ালই করিনি !"

"কোন ব্যাপারনা এরিক | চলো এখন নিচে |"

আলিজা আর আইলান নিচে গেলে নাফি বলল, আয় তো তোরা ! ববি আপারা এসেছে !"

আইলান আলিজার দিকে চেয়ে বলল, "কে রে ?"

আলিজা নাফিকে বলল, "আপনার ওই খালাতো বোনটা না ? ধানমন্ডি আটে থাকে যেটা ? স্বামী ডাক্তার ?"

নাফি উচ্ছাসিত হাসি দিয়ে বলল, "হ্যা হ্যা ! চিনেছিস তো তাহলে ?"

আলিজা গম্ভীরভাবে বলল, "চিনবোনা কেন ?"

আইলান বোনের মুখের দিকে চেয়ে বলল, "থাক লক্ষ্মী ! যাসনা |"

"না ভাইয়া, যাবো | পুরোনো হিসাব বাকি |"

আইলানও এলো বোনের হাতটা ধরে |

মাহিরার সামনেই চেয়ার নিয়ে বসেছে ববি আর তার স্বামী |

আলিজা গেলে নাফি বলল, "এইযে আপা এটা বুবুর মেয়ে আর ও ছেলে |"

আলিজা আগ্রহহীনভাবে সালাম দিলো |

ববি আগ্রহনিয়ে কথা বললেও তার স্বামীর কোন আগ্রহ দেখা গেল না | কিন্তু কিছুক্ষন পর আইলানের মাল্টিন্যাশনাল কোম্প্যানিতে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পোস্ট ও তার ব্যারিস্টার স্ত্রীর বৃত্তান্ত আর আলিজার পিএইচডি, তার আমেরিকান নাগরিকত্ব ও সেখানকার গ্র্যাডস্কুলে শিক্ষকতা আর তার আমেরিকান বংশোদ্ভুত স্বামীর এএ-এর সিনিয়ার কমার্শিয়াল পাইলট হিসেবে ক্যাপ্টেন পোস্টের পরিচয় বেরিয়ে এলে ভদ্রলোক খুবই আগ্রহী হয়ে পড়লেন | তিনি একাধিকবার আইলানকে ও আলিজাকে তার বাসায় যেতে বললেন ও নিজের কার্ড দিয়ে দিলেন |

তিনি উঠার সময় আবার বললেন, "যেও কিন্তু ! অনেকদিন তো আছো আম্মু |"

এতক্ষন শুধু সৌজন্য কথা বললেও এবার আলিজা বলল, "এবার গেলে বোধহয় দেখা করবেন তাইনা ?"

ভদ্রলোক চমকে উঠলেন |

নাফি চোখের ইশারায় তাকে চুপ করতে বলে দ্রুত বলল, "হ্যা হ্যা যাবে ওরা |"

আলিজা শান্তভাবে বলল, "না | আমি বা ভাইয়া আমরা কেউই যাবোনা |"

নাফি অতি বিনয়ী হয়ে বলল, "ছি মা ! এভাবে বলে কেউ ?"

আলিজা নাফিকে কোনরকম গ্রাহ্যই না করে ববি আর তার স্বামীকে বলল, "একবার বছর দশেক আগে আমি তখনও ইউএস যাইনি তখন নাফির সঙ্গেই আমার মায়ের কি যেন দরকারে সাথে আপনার সাথে দেখা করতে আপনার চেম্বারে গিয়েছিলাম | অন্তত পাঁচবার বলে আপনার এপয়েন্টমেন্ট নিয়েই গিয়েছিলাম | কিন্তু আপনি আপনার চেম্বারের পিএসকে বলে আমাদেরকে ঢুকতে দিতে নিষেধ করেছিলেন আর আমাদের ফোনও আর ধরেননি | আমরা রাত নয়টা পর্যন্ত বসে ছিলাম বাইরে | নাফি ধনীদের অপমান গায়ে মাখেনা তাই ও জোরকরে ধরে রেখেছিল আমাকে | কিন্তু নয়টা হতেই আমি ওকে আর তোয়াক্কা না করে ঘরে ফিরে আসি | কারন অবস্থা যখন যাই ছিলোনা কেন আমাদের, আমার আর আমার ভাইয়ের আত্মসম্মানবোধ সবসময়ই বেশি |"

ববি আর তার খ্যাত ডাক্তার স্বামী বোবা হয়ে গেল |

ভদ্রলোক নিজেকে বাঁচাতে বললেন, "আসলে হয়কি অনেক ব্যস্ত থাকি তো চেম্বারে ......."

"আমি যেখানে পড়াশুনা করেছি সেখানে অনেক অনেক বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারেরা রয়েছেন মেডিক্যাল স্কুলে | এদের অনেককেই আমি দেখেছি সকালে মালিকে গাছে পানি দিতে সাহায্য করছেন, কেউ বিনামূল্যে ক্যাম্পে রুগী দেখছেন আর কেউ রাস্তায় থাকা হোমলেসদের লাঞ্চ কিনে দিচ্ছেন | ওখানেও অনেক শিকড়চ্যুত রুঢ়ভাষী আছে আপনার মত | তবে কি আমাদের দেশে এর সংখ্যাটা বেশি | আর আপনি চেম্বারের কথা বললেন, আপনার সাথে চেম্বারে দেখা না পেয়ে আমার মা কয়েকদিন পর আমাকে নিয়ে আপনার এপার্টমেন্টেই যান | সেদিন শবেমেরাজ ছিল, আমি আর মা নফল রোজা ছিলাম | তখন সন্ধ্যা হয় হয় | আমরা দুজনে দেড়ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম | কিন্তু আপনি আর আপনার স্ত্রী আমাদেরকে ভেতরে যাবার অনুমতি দেননি রিসেপশনে থেকে যখন ফোন করি আমরা ! পরে যখন প্রায় এশার ওয়াক্ত হয় তখন আমি আর দাঁড়াইনি | একটা দোকান থেকে একটা পানির বোতল কিনে মাকে দেই আমি | একথা আমার জীবনে আমি কোনদিন ভুলবোনা সেদিন যা করেছিলেন আপনারা |"

দুজনেই মাথানিচু করে চুপ করে রইল |

আলিজা ববির দিকে চেয়ে বলল, "মা আমাকে বলেছিল আপনি নাকি অনেকবার এবাড়ি এসে অনেকদিন করে থেকে গিয়েছেন বিয়ের আগপর্যন্ত ! তখনও তো এরা গরিব ছিল | অথচ ধনীলোকের স্ত্রী হতেই আপনার মনে হল দরিদ্র আত্মীয়রা ভিক্ষে চাইতে ছাড়া হয়ত আর কোন কাজে আসেনা তাইনা ? ভাইয়ার কার্ড তো আছে আপনার কাছে আর বাসার ঠিকানাও জানলেন | আপনারা যাই করেছিলেননা কেন সেসময় আমরা কিন্তু আপনারা কখনও আমাদের ঘরে এলে আমাদের এপার্টমেন্টের রিসেপশন থেকে বের করে দেব না ! মেহমানদের সম্মান আমরা দিতে জানি |"

বিদায়ের আগে মাহিরাকে নাহারের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গেল আলিজা |

মাহিরা আঁচলটেনে টেনে দাঁড়িয়ে নাহারের পা ছুঁয়ে সালাম করল | নাহার তাকে ধরে পাশে বসালেন |

আলিজা মুখে হাসি কিন্তু চোখে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রেখে নাহারকে বলল, "নানু ! আগেই বলি আমার সামনে কিন্তু আমার ভাবীকে কোন টিটকিরি কি ট্যাড়াব্যাঁকা কিছু বলবেন না !"

নাহারের ঘরে নতুন এসে বসা সবাই মহা বিস্ময়ে দেখছে আলিজা আর মাহিরাকে | এত সচ্ছল আর দুই বিদেশি নাগরিক এই মেয়ে দুজনে কিন্তু তাদের কথাবার্তা, আচরণ আর সাজপোশাকে কোনভাবেই কোন উগ্রতার প্রকাশ নেই | বরং একটা অদৃশ্য অভিজাত্য |

নাহার ইনিয়েবিনিয়ে নানাভাবে আলিজা আর আইলানকে বললেন, "তোরা নাকি কতবড় ঘরবাড়ি করেছিস ! এত বড়বড় রুম নাকি ! কই একবার নিয়ে তো গেলিনা ! একবার নিয়ে যা আমাকে ! এতবড় বাড়ি দেখে আসি, মাসখানেক ঘুরে আসি আর নাতবৌয়ের রাঁধা ভাত খেয়ে আসি | কত মজা হবে ! চল না আমাকে নিয়ে একবার !"

তিনজনের কেউই কিছু বললনা দেখে নাহার মাহিরাকে বলল, "নাতবৌ তোমার বড়মামাশশুর অনেক বলে তোমাদের কথা ! অনেক সুনাম করে !"

আলিজা আর আইলান মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একটু হাসল |

নাহার বৌয়ের হাতটা ধরে বলতে লাগলেন, "একদিন দাওয়াত করো তোমার বড়মামাশশুরকে কেমন ! আজ আমার ফামিদ বেঁচে থাকলে আমাকে ওর কাছেই রাখতো | নেই ও তাই আমার কেউ নেই | এখন তোমরা আছো শেষ বয়েসে তোমাদের সাথে থাকব | নাতিপুতি নিয়ে ঘর করব | নাতবৌয়ের রান্না খাবো, নাতনির পা টেপা নেবো | কি বলো নাতবৌ ? নিয়ে যাবে তো আমাকে ? কবে নেবে ?"

আলিজা আস্তে করে নাহারের হাতটা সরিয়ে দিয়ে আইলানকে ইশারা করল |

একটু হেসে "আসি নানু, বসেন আপনি |" বলে স্বামীর সঙ্গে উঠে গেল |

আলিজা নাহারের এই কুৎসিত স্বভাব জানে | সে মানুষকে আবেগতাড়িত করে নিপূণভাবে ব্যবহার করে নিজ স্বার্থ আদায়ে | আর তার আরেকটা ভয়ংকর স্বভাব হল তার দাবি আদায় না হলে সে কঠিন কঠিন সব অভিশাপ করে |

দিনরাত লাঞ্ছনা যাদের করত আজকে নিজের দুর্দিনে তাদের ঘরে গিয়ে উঠার জন্য কি সুচারু অভিনয় করছে | আলিজা এজন্যই সরিয়ে দিল মাহিরাকে | নাহারের কথা না মানলে একটা গর্ভবতী মহিলাকে তার সন্তান নিয়ে অভিশাপ করতে একটুও বিচলিত হবেনা নাহার |

আলিজা রীতিমত রেগে গিয়ে নাফি আর তার স্বামীকে বলল, "কি ধরনের ফাজলামো এগুলো ? মানলাম আপনাদের সম্পর্কটা রসিকতার ! কিন্তু এসব কি !"

আলিজা বিপ্লবকে একটা মাউথ আলসার জেল আনতে পাঠিয়েছিল | সে জেলটা এনে আলিজার হাতে দিল |

আলিজা হাতের আঙুলে জেল নিয়ে রজারকে বলল, "ড্যাড মুখ খুলুন তো ! এটা এখন লাগিয়ে নিন | পরে ঘরে ফিরে ডাক্তার দেখাবো |"

রজার একটু হেসে বলল, "তুমি রাগ কেন হচ্ছো ! কোন ব্যাপার না |"

"ব্যাপার কিনা আমি জানি |"

রজারকে একগাদা পাথুরে চুন দিয়ে নাফির স্বামী পান খাইয়ে দিয়েছে | তার মুখ পুড়ে জ্বালা হয়ে গিয়েছে ! এতেই আলিজা রেগে অস্থির |

সবার কাছে বিদায় নিয়ে আলিজা আর আইলান নাহারের কাছে এলো |

সালাম করে আইলান বলল, "নানু আসি তাহলে |"

নাহার বললেন, "আচ্ছা | আসবি কবে নিতে ?"

"আপনার যখন যেটা খেতে ইচ্ছা হয় জানাবেন | নানু আপনার যখন যা লাগে, ডাক্তার দেখানো, ওষুধপত্র, কাপড়চোপড়, তেলসাবান আমাদেরকে জানাবেন | আমরা আপনাদের ওই আগের বুয়াকে সবসময়ের জন্য রেখে যাচ্ছি আপনার জন্য | প্রতিমাসে আমি আমার ড্রাইভারের হাতে আপনার প্রয়োজনীয় সবকিছু পাঠিয়ে দেব |"

নাহার আশাহতভাবে বললেন, "আমাকে নিয়ে যাবি না ?"

"না নানু | আচ্ছা ভালো থেকেন | আসি কেমন !"

আলিজা আর আইলান বেরিয়ে এলো |

প্রায় পড়েই যেতে গিয়ে স্বামীর হাত ধীরে নিজেকে সামলে আলিজা বহুকষ্টে পাশ ফিরে দেখল এরিক সবসময় যা করে তাই করেছে ! এতবড় কিংসাইজ ডাবলবেড খাটের একেবারে বিপদসীমায় এসে আটকে আছে সে আর এরিক তাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে মরার মত ঘুমাচ্ছে প্রায় সম্পূর্ণটা বিছানা খালি রেখে |

এরিক সবসময় এমন করে ঘুমালে | ঘুমের মধ্যে আলিজার কাছে ঘেঁষতে ঘেঁষতে একেবারে কিনারে এনে ফেলে | এই বিপদের জন্য আলিজা একটা কোলবালিশ মাঝে দেয় কিন্তু কোন লাভ হয়না ! আলিজা প্রায়ই দেখে সে এমন বিপজ্জনক কিনারায় এসে বিছানা থেকে মেঝেতে পড়ার পূর্বপ্রস্তুতিতে আর এরিকের অংশে কোলবালিশটা ঘুমাচ্ছে !

আলিজা বিরক্তিতে এরিককে ডেকে বলল, "এরিক ! এরিক ! এই সরো তো ! পড়েই যাবো আমি এখন |"

এরিক ঘুমঘোরে বলল, "উহু ! পড়বেনা | আমি ধরে আছি !"

"এরিক ওঠো তো | উঠে সরো একটু | আমি পড়ে যাচ্ছি বিছানা থেকে |"

এটা বলেই আলিজার মনে হল এটা আরেক বেফাঁস বলা হল ! কারন পরমুহূর্তেই এরিক তাকে দুহাতে জড়িয়ে নিজের গায়ের সাথে চেপে ধরে তাকেসহ পাশ ফিরল | ফলে আবার বিছানার মাঝে এলো আলিজা |

আলিজা অসহায়ভাবে বলল, "কোন লাভ নেই তোমাকে কোনকিছু বলে !"

"হুম ! লিজ খুব ঘুম পেয়েছে আমার ! আর প্লিজ এখন বলোনা যে তুমি বাথরুমে যাবে |"

আলিজা বলল, "আমি বাথরুমেও যেতে পারব না ?"

"এখন না | তুমি উঠে গেলে আমার ঘুম চলে যায় |"

আলিজা হেসে ফেলল, বলল, "ঘুমাও তুমি | আমি কোথাও যাচ্ছিনা |"

"হুমম | যেওনা |"

আলিজা পাশ ফিরে এরিকের চুলে আঙ্গুল চালিয়ে দিতে লাগল |

আবার জড়িয়ে ধরল এরিক তাকে | ঘুমস্বরে বলল, "আর কিছুক্ষন |"

"দিচ্ছি |"

আলিজার গায়ের উপর এরিকের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো কিছু সময় পর | আলিজা এরিকের দিকে তাকাল | কি আরামে ঘুমাচ্ছে | মাঝে মাঝে এরিককে দেখে সে খুব অবাকই হয় ! কে জানত ওরকম তেড়িয়া, বেপরোয়া, রাগী, জেদি আর দুঃসাহসী মানুষের পেছনে এমন একজন গৃহী ও শিশুসুলভ সত্তা রয়েছে |

আলিজা জেগেই রইল |

এরকম রাতে তার ঘুম চলে গেলে সেই দিনটার সেই সময়গুলোর কথাই তার মনে হয় |

সেই দিনটা ! একটা অজানা কষ্ট যখন তার বুকটার ভেতর শ্বাসরোধকরভাবে জানান দিচ্ছিলো তখনই এরিক তাকে এমনভাবে কাছে টেনে নিলো তার ঠোঁটদুটোকে নিজের ঠোঁটে বন্দীকরে | এরিক তার স্পর্শেই তার চাওয়া, তার দাবি জানিয়ে দিয়েছিলো যা ভাষায় সে বলতে পারেনি আলিজাকে দীর্ঘদিন | কিন্তু এরপরেও এরিক স্পস্টভাষ্যে তার চাওয়া জানিয়েছিল | সে আলিজাকে বিয়ে করতে চায়, তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে চায় | কিন্তু আলিজা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ | তার মন কোন সিদ্ধান্তই দিতে পারছিলোনা !

আলিজার সামনে তার হাতটা ধরে এরিক সিক্তচোখে হাটুগেড়ে বসে | তাকে ভালোবাসে এরিক |

কিন্তু ডক্টর মারলেই ? তিনিও তো আলিজাকে পছন্দ করেন | আলিজা তার বাগদত্তা | তারা শীঘ্রই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে |

আলিজা ঝট করে এরিকের হাত থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, "এটা হয়না এরিক ! এটা সম্ভব না |"

আলিজা এরিকের সামনে থেকে প্রায় দৌড়ে চলে গেল |

আলিজা তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ওয়েস্টহ্যাম্পটন লেকের গ্যাজিবোতে এসে বসল | হাউমাউ করে কাঁদল কিছুক্ষন সে | এমন কেন হল ! হঠাৎ তার এরিকের জন্য এত কষ্ট কেন লাগছে ? যে অনুভূতিকে সে বাড়তে দেয়নি কোনদিন তা তার অজান্তেই নিজেরমত কবে কখন এতদূর হয়েছে তা জানেইনা আলিজা ! সবসময় কথাই নিজেকে সে বুঝিয়েছে যে, সে ভালোবাসেনা এরিককে আর কখনও ভালোবাসবেওনা ! তবে আজ কি হল তার ?

সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে আলিজা ড. মারলেইকে ফোন করল | উনি ধরলেন না | আবার ফোন করল আলিজা | এবারও জবাব নেই | তিনবারের বেলায় ফোন ধরলেন ডক্টর |

ড. মারলেই ফোন ধরেই বেশ গম্ভীরভাবে বললেন, "মিস এহমেড তুমি কি কোরছোটা কি বলতো ? তুমি আমার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন কেন দিয়েছো ? আমার নম্বর 'বাগড' ( রেকর্ড ) করা হয়ে থাকতে পারে | এ অবস্থায় তোমার এ নম্বরে ফোন করাটা শুধু বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয় !"

আলিজা বহুকষ্টে কান্না চেপে বলল, "ডক্টর আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই ! প্লিজ ডক্টর ! আমি খুব কষ্টে আছি |"

"কি হয়েছে তোমার ? তুমি কি আর্থিক কোন সমস্যার মধ্যে রয়েছো ? সেরকমটা তো হবার কথা নয় !"

"না ডক্টর আথিক কোন সমস্যা নয় | আমি মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত রয়েছি | আমার সাথে একবার দেখা করুন ডক্টর |"

"মিস এহমেড তুমি জানো যে এটা একেবারেই সম্ভব নয় এখন | কোন অবস্থাতেই এখন আমি তোমার সাথে কোনরকম ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার রাখতে পারছিনা |"

আলিজা কেঁদে ফেলল, বলল, "ড. আমি আপনার কাছে আপনার কিছু সময় ভিক্ষা চাইছি | প্লিজ ডক্টর ! আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই ! আমি খুব মানসিক সংকটে রয়েছি |"

"মিস এহমেড, তুমি একজন বিচক্ষণ নারী | তোমাকে এভাবে কাঁদাটা শোভা দেয়না | আমার কথা শোনো | মাথাটা ঠান্ডা করো | আজ বিকেলে গিয়ে তুমি তোমার এটর্নির সঙ্গে কথা বলো |"

ডক্টর ফোন রেখে দিলেন |

আলিজা প্রায় আধঘন্টা অসহায়ের মত গ্যাজিবোতে বসে কান্নাকাটি করে ডরমেটরিতে ফিরল | পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে কিছু সৌজন্য কথাবার্তা বলে ঘরে এলো | এভরণ নেই | বোধহয় ল্যাবে এখনও |

আলিজা অবাক হয়ে দেখল তার ট্রলি ব্যাগটা ! সে ভুলেই গিয়েছিল এর কথা | তখন অমন দৌড়ে এরিকের সামনে থেকে চলে গিয়েছিল এটা ফেলে রেখেই |

কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো | ব্যাগের কাপড়গুলো তুলে দিয়ে ব্যাগটা খালি করতে হবে |

আলিজা তার আলমারির উপরের তাকটা খালি করার জন্য আগের শাড়িগুলো নামালো | তখনই একটা জিনিস মেঝেতে পড়ল | আলিজা ঝুঁকে তুলল সেটা |

এরিকের সেই চিঠিটা ! কখনোই খোলা হয়নি চিঠিটা | কিন্তু সযত্নে নিজের কাছেই রেখেছিল একে আলিজা এটা হাতে পাবার পর থেকে সবসময় !

আলিজা চিঠিটা রেখে দিল |

সব শাড়ি গুছিয়ে তুলে রেখে আলমারি বন্ধ করবে তখন ফোন এলো | আলিজার এটর্নি ফোন করেছে | ভদ্রলোক আজ চারটায় তাকে সময় দিতে পারবেননা | আলিজাকে তিনটায় সেখানে যেতে হবে | আলিজা তিনটার সময়ই থাকবে সেখানে জানিয়ে সে কাপড়গুলো সব গুছিয়ে উবার সার্ভিসে ফোন দিয়ে চুপ করে বিছানায় এসে বসল |

আলিজা হঠাৎ উঠে গিয়ে আলমারি খুলল | ড্রয়ার খুলে খামটা হাতে নিলো | এরিকের চিঠির খামটা |

আলিজার এটর্নি অলিভার হলস খুবই সদালাপী চমৎকার মানুষ | তাকে খুবই পছন্দ হল আলিজার | ভদ্রলোকের সত্যভাষণ আলিজাকে মুগ্ধ করল | একমাস পরের ট্রায়ালের সব তথ্যই সে আলিজাকে নির্বিকারভাবে দিয়ে দিলো | তিনি এও জানালেন যে আগামী ছয়মাস অন্তত ড. মারলেই আলিজাকে কোনরকম কোন সাহায্য ও যোগাযোগ করবেননা |

মি. হলস একটা বিচক্ষনই হাসি দিয়ে বললেন, "মিস এমেড আপনার স্বার্থেই আপনাকে জানাচ্ছি আমি একথা | ড. মারলেই অনেক পছন্দ করেন আপনাকে | উনি সবই করবেন আপনার জন্য নেপথ্যে থেকে | কিন্তু উনি আপনার সামনে আসবেন না এর মধ্যে আর | উনি খুবই পছন্দ করেন আপনাকে তার প্রমান আমি পেয়েছি কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্ব আর খ্যাতির চেয়ে বেশি তিনি কোনকিছুকেই ভালোবাসেন না |"

মি. হলস জানালেন যে এ মুহূর্তে ট্রায়ালের ফলাফলের পরপরই ডক্টর অন্য একটা নকল সম্পর্কে জড়াবেন মাস সাতেকের জন্য | সেটার সবিছুই ঠিকঠাক | এরপর ট্রায়ালের ফলাফল হতে ঠিক দেড়বছর পর তিনি আলিজাকে বিয়ে করে জার্মান চলে যাবেন | এসবকিছুই ডক্টর মি. হলসকে বলেছেন আলিজাকে জানানোর জন্য |

আলিজা সব শুনে বলল, "ড. মারলেই এসব আমাকে নিজে কেন জানালেন না ?"

"কেননা উনি আপনাকে আহত করতে চাইছিলেন না |"

মি. হলস মামলা বিষয়ক বিভিন্ন ব্যাপারে কথা বলতে লাগলেন আলিজাকে | আলিজা হঠাৎ মি.হলসকে জিজ্ঞাসা করল, "মি. হলস আজ কি বার ?"

মি. হলস বললেন, "জ্বি মিস এমেড ? এখন অনুগ্রহ করে আমার কথাগুলো মনোযোগের সাথে শুনুন | এর সবকিছুই খুব গুরুত্বপূর্ণ |"

আলিজা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "মি. হলস আমি দুঃখিত | আমাকে এখনই কোথাও যেতে হবে |"

"কোথায় এমন দরকার আপনার যে এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রেখে আপনি ছুটেছেন ?"

"আমাকে ব্যাংক যেতে হবে |"

"মিস এমেড বসুন আপনি |"

"না মি. হলস | আমি এখনই যাবো | আজতো ব্যাংকের কিছু কার্যক্রম পাঁচটা পর্যন্ত চলবে | আমি আসি | আমি পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব |"

আলিজা এটর্নির চেম্বার থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে এসে ট্যাক্সি নিয়ে ডরমেটরিতে ফিরল | এভরণ এসেছে |

আলিজা এভরণকে একবার জড়িয়ে ধরে বলল, "এভি আমি এখনই আসছি |"

আলিজা দ্রুত যা যা নেবার তা নিয়ে নিচে নেমে গেল | সে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়েই এসেছিল |

আলিজা ব্যাংক অব আমেরিকা-র ভল্ট সেকশন-এ গেলো | আলিজা সব তথ্য সেখানকার কর্মী মহিলাটিকে দিলে সে আলিজাকে সাথে আসতে বলল | আলিজা ভল্টরুমে গিয়ে আলিজার হাতে দুটো চাবি দিয়ে তার ভল্টটা দেখিয়ে দিল | আলিজা কাঁপা কাঁপা হাতে চাবি ঘুরিয়ে ভল্ট খুলল |

ভল্টে রাখা বক্সটা বের করে খুলে দেখে সে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল |

সারাদিন ছন্নছাড়ার মত এদিকসেদিক ঘুরে বেশ খানিকটা হার্ড লিকার ( কড়া মদ ) নিয়ে এরিক রাতে ঘরে ফিরল | দরজায় হাত দিয়েই দেখল তার ঘরের দরজা খোলা | এতো সাধারণ তালা নয় | এ খুলতে গেলে এলার্ম বেজে যাবে | তৎক্ষণাৎ নেশা চলে গেল তার, শরীরের সামরিক রক্ত কথা বলে উঠল |

এরিক সাবধানে গাড়িতে ফিরে গ্লোভ কম্পার্টমেন্টের বুবি ড্রয়ার থেকে তার লোডেড ফোর্টি ক্যালিবারের হ্যান্ডগানটা বের করে পিছনে কোমরে বেল্টে গুঁজে রেখে তার কোটটা আবার গায়ে দিল | একইসাথে তার ছোট কমব্যাট নাইফটা বাঁপায়ের মোজায় গুঁজে নিয়ে প্যান্টের আড়ালে ঢাকল | এবার প্রস্তুতি নিয়ে সাবধানে দরজা খুলল |

ঘরের একটা আলো জ্বলছে | এরিক সাবধানে ভিতরে এগিয়ে প্রথমে ড্রয়ার ক্যাবিনেট দেখল আর ছবিটা সরিয়ে দেখল | না, সব ঠিক রয়েছে | তো ঘরে ঢুকল কে ?

এরিক ঘুরতেই তার চোখ পড়ল সোফার সামনের টেবিলের উপর | এরিকের দাদির চেনেহারটা যেটা সে আলিজাকে দিয়েছিল আজ দুপুরে !

এরিক তৎক্ষনাৎ মুহূর্তের মধ্যে তার হ্যান্ডগানটা হাতে নিয়ে সেফটি ক্ল্যাচ খুলে স্লাইড করে নিয়ে আলিজার নাম ধরে ডেকে বলল, "লিজ ! আমাকে শুনতে পাচ্ছ তুমি ? তুমি কি এখানে আছো ?"

এরিক দ্রুত রান্নাঘরে গেল, গেস্টরুমে আর নিচের অন্য দুটো বেডরুমে গেল | তার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছে |

এরিক এক লাথিতে সেলারের দরজা ভেঙে বন্দুক তাক করে ভেতরে ঢুকে বলল, "তুমি যেই হও সামনে আসো ! মেয়েটিকে যেতে দাও | ওকে ছেড়ে দাও |"

কোন উত্তর নেই দেখে এরিক আবার প্রশ্ন করল, "দ্যাখো আমি জানিনা কে পাঠিয়েছে তোমাকে ? সে কি গ্লেন ? যদি গ্লেন হয়ে থাকে তো জেনে রাখো যদি মেয়েটার গায়ে আঁচড়ও লাগে তো আমি তোমাকে আর গ্লেনকে দুজনকেই আমি খুন করে ফেলব !"

সেলারের বাতি জ্বেলে দেখল কেউ নেই |

এরিক দোতালায় গিয়ে আবার ডাকল, "লিজ ! লিজ যদি আমাকে শুনতে পেয়ে থাকো তো জবাব দাও আমাকে |"

এরিক নিজের বেডরুমে ঢুকে দেখল বিছানার উপর কি যেন | এরিক এগিয়ে এসে তুলে নিয়ে দেখল তার সেই চিঠিটা যেটা সে প্রায় সাতমাস আগে আলিজাকে দিয়েছিল ওয়ারশো থেকে | চিঠির পাশে তার ঘরের আর ব্যাংকের লকারের চাবি |

এরিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল | সবকিছু এখন স্পষ্ট হল |

এরিক ট্যারেসে এসে দেখল আলিজা ঠিক সেই জায়গাটায় পিছনফিরে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে দাঁড়িয়ে প্রায় এগারোমাস সময় আগে এরিক প্রথম তাকে অধরবন্দী করতে গিয়েছিল |

এরিক এগিয়ে গিয়ে তার হ্যান্ডগানটা সোফার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল | আলিজা এবার ফিরে তাকাল |

এরিকের দিকে চেয়ে আলিজা বলল, "এরিক কি হয়েছে তোমার ? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে ?"

এরিক কোন কথার জবাব না দিয়ে দ্রুতপায়ে সামনে এগিয়ে এসে আলিজার দুগালের উপর হাত রেখে আলিজার ঠোঁটদুটোকে নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে বন্দি করল | সময়ের খেয়াল দুজনের কেউই আর মনে রাখল না সেই মুহূর্তে |

আলিজা মাথাটা এরিকের বুকের মাঝে রেখে রেলিঙের উপর বসে আর এরিক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাকে জড়িয়ে ধরে | আলিজার গায়ে এরিকের কোটটা জড়ানো | ভাল বাতাস হচ্ছে | আলিজার শাড়ির আঁচলটা উড়ে এসে বারবার এরিকের গায়ের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে |

এরিক আলিজার মাথার উপর একটা চুমু দিয়ে আর্দ্রস্বরে বলল, "জবাব দিচ্ছিলে না কেন লিজ ? আমার হাতে ৪০ ক্যালিবার হ্যান্ডগান ছিল | যদি চালিয়ে বসতাম আমি তো তখন কি হত ? মারাও যেতে পারতে তুমি |"

"হয়ত এরিক |"

"হয়ত ? আমার কথা কখনোই ভেবোনা তুমি তাইনা ? আমার হাতে তোমাকে লেগে গেলে আমার অবস্থাটা কি হত ভেবেছো ?"

"না | ভাবিনি | কারন সে ভয় হলে আমি এখানে আসতাম না |"

"লিজ ?"

"বলো |"

"তুমি কিছু ভেবোনা আর | আমি রয়েছি সবকিছুর জন্য |"

"আমি কিছুই ভাবছিনা | এরিক ?"

"বলো |"

"আমি বোধহয় ভুল সময়ে তোমার চিঠিটা খুলেছি |"

এরিক আরো শক্তকরে জড়িয়ে ধরে বলল, "না লিজ | একদম সঠিক সময়ে খুলেছো |"

এরিকের চিঠিতে লেখা ছিল,

"লিজ, কোন সম্বোধন ছাড়াই লিখলাম | আমি জানি তুমি খুব সংকটময় সময় অতিক্রম করছো | তোমার খুবই কষ্ট যাচ্ছে | কিন্তু তুমি আমাকে সাহায্য করতে দিচ্ছোনা | লিজ আমি তো তোমার পর নই | আমি নিজেও জানিনা যে কখন তুমি আমার এতটা কাছের একজন হয়েছো | লিজ তুমি বন্ধু আমার এখনও আছো আর চিরদিন থাকবে কিন্তু আমার অজান্তেই আমার তোমার প্রতি অনুভতি আরেকটা অনেকবড় ধাপ এগিয়ে নিয়েছে আমার মন | তুমি বুঝতে পারো সেটা তা আমি জানি | তুমি আমার কোন সাহায্য নিচ্ছোনা আর আমাকেও কোনরকম সাহায্য করতে দিচ্ছোনা ব্যাপারটা আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে | কি করলে তুমি আমাকে সত্যিই বিশ্বাস করবে আর নিজের আপন বলে মানবে ? হয়ত এই চিঠিটা পড়ার পর তুমি আর কোন যোগাযোগ রাখবেনা আমার সাথে | তাও বলছি তোমাকে | সে একজন আমি হতে চাই তোমার |

জানি তুমি আমাকে খুব খারাপ একজন মানুষ ভাবো | রাগী, মেজাজি, বেপরোয়া, বহুপ্রেমিক আর সবচেয়ে বড় কথা তুমি এটা জানো যে আমি একজন স্পেশাল অপরেশন এজেন্ট | আমার পেশায় আমাকে অনেক সাংঘাতিক কাজই করতে হয় যা হয়ত একজন সাধারণ মানুষের কাছে নিন্দনীয় | কিন্তু সবজেনেও তুমি আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখেছো | তুমি আমাকে ঘেন্না করলে তা হত না |

লিজ আমাকে তোমার একজন সত্যিকারের কাছের মানুষ হবার সুযোগ দাও | আমি অনেক ত্রুটিপূর্ণ মানুষ কিন্তু তোমার প্রতি আমার অনুভতিতে কোন ত্রুটি নেই |

তুমি আমাকে তোমায় সাহায্য করতে দিতে চাও কি না তা জানতে চাইব না | কিন্তু আমার কর্তব্য আমি করলাম | এতে তুমি ক্রুদ্ধ হলেও ক্ষতি নেই | ভালোবাসি তাই ভালোবাসার দাবিতেই এই দায়িত্ব আমি নিলাম আর কর্তব্যটাও স্বীকার করলাম |

পুনশ্চ : তোমাকে একটা ভল্টের একাউন্ট নম্বর আর কোড উল্লেখ করে দিলাম | তুমি এটা নিয়ে ব্যাংক অব আমেরিকার ভল্ট সেকশনের কর্মরত মহিলা কর্মীটিকে দেবে | সে তোমাকে দেখেই চিনবে | তখন সে তোমাকে তোমার ভল্ট দেখিয়ে দেবে | তাতে তোমার জন্য একটা জিনিস রাখা রয়েছে | আশাকরি তুমি এরপর নিজের জবাব আমাকে জানাবে |

ভালো থেকো লিজ |

এরিক "

এরিকের চিঠির সাথে একটা ১০,০০০ ডলারের চেক ছিল যা সে আলিজার আর্থিক সমস্যার সময় একজন বন্ধুর কর্তব্য হিসেবে দিয়েছিল |

এরিকের ভল্টে রাখা বক্সে এরিকের ঘরের চাবি আর একটা চিরকুট ছিল |

চিরকুটে লেখা ছিল, "যখন যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আমি রাস্তায় পড়েছিলাম তখন যে করুণাময়ী আমার হাতটা ধরে আমাকে টেনে তুলে ঘরে নিয়ে এসে আমাকে নতুন জীবন দিয়েছিল তার জন্য আমার ঘরে আর মনে সবসময় স্থান থাকবে |"


সকাল নয়টা | আলিজা যাবার পর আইলান খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে দেখে মনজুর বাধ্য হয়েই হবু পুত্রবধূকে ডেকে এনেছেন | মাহিরা সকালেই এসে পড়েছে | আলিজার অনুপস্থিতির শোকে আর কান্নাকাটি করে আইলানের শরীর বেশ খারাপ তাই অফিসে যাবেনা আজ সে |

মাহিরা নাশতা বেড়ে আইলান আর মনজুরকে খেতে বসিয়েছে তখনই ফোন বাজল |

আইলান দেখল আইডি রেস্ট্রিকটেড নম্বর | তাই ধরলোনা কিন্তু আবার বেজে উঠল ফোন |

এবার ফোন ধরল | আলিজার গলা, "কেমন আছিস ভাইয়া ?"

আইলানের বুকটায় মোচড় দিয়ে উঠল | তার চোখে পানি এসে গেল |

আইলান কৃত্তিম একটা ধমক দিয়ে বলল, "তোকে বলেছি পৌঁছেই ফোন করতে ! এতক্ষনে সময় হল তোর ?"

"স্যরি ভাইয়া |"

"কেমন আছিস ?"

"ভালো | তুই ?"

"ভালোনা |"

"এমন অস্থির কেন তুই ভাইয়া !"

আলিজা কাঁদছে |

আইলান চোখমুছে বলল, "এই কাঁদিসনা | লক্ষ্মী আমার কাঁদিস না | কি হয়েছে ?"

"ভাইয়া একটা কথা বলতে চাই তোকে |"

"বল |"

আলিজা কিছুই বলতে পারছেনা | তার কান্নার গুঞ্জন শুধু আইলান শুনল |

আইলান অস্থিরভাবে জিজ্ঞাসা করতে লাগল , "এই আলিজা কি হয়েছে ? বেবি বল আমাকে ! কি হয়েছে তোর ?"

মাহিরা উঠে এসে পাশে দাঁড়ালো, সে ফোনটা স্পিকারে দিতে ইশারা করল আইলানকে |

কিছুক্ষন নীরবতা | এরপর এরিকের কণ্ঠ শোনা গেল, "এলান আমি এরিক বলছি |"

আইলান বিস্মিত হয়ে বলল, "এরিক ? তুমি ? আলিজার কি হয়েছে ? এরিক ওর হয়েছেটা কি ?"

"শান্ত হও | বলছি |"

এরিক একটু চুপ থেকে বলল, "এলান আমি লিজকে বিয়ে করতে চাই | আমি ওকে আমার জীবনসঙ্গী বানাতে চাই |"

মাহিরা একটা উচ্ছাসভরা হাসি দিয়ে আইলানের হাতটা ধরে বলল, "অবশেষে এরিক ! শেষ পর্যন্ত শুনলে আমার কথা তুমি ! আমি জানতাম তুমি ওকে ভালোবাসো আর ও তোমাকে কিন্তু কি ভুলোয় পেয়েছিল তোমাদের দুজনকে কে জানে ! সেদিন রাতে তাই তোমার অস্থির অবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে আমি বলেছিলাম তোমাকে ওই কথাগুলো | এরিক আলিজা কি বলে ?"

এরিক বলল, "ধন্যবাদ ব্রিটিশ ওমেন ! তুমি ওই তেড়িয়া কথাগুলো না বললে হয়ত আমি এতটা মরিয়া হতাম না |"

মাহিরারও চোখে পানি এসে গিয়েছে | সে আঁচলে চোখমুছে বলল, "এমনি বলিনি আমি ওই কথাগুলো | তুমি ওর দিকে যখন তাকাও আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম তোমার চোখে ওর প্রতি আগ্রহটা | আর যখনই ও ড. মারলেইয়ের কথা বলত তুমি অন্যদিকে চেয়ে থাকতে | তোমার চাউনিতেই বুঝতাম আমি যে জ্বলে যেত তোমার ভেতরটায় | আর তোমাদের ফ্লাইটের আগের সেদিন রাতে তাকানো যাচ্ছিলোনা তোমার দিকে ওই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হবার পর | তুমি যেন প্রতিমুহূর্তে আরো অস্থির হচ্ছিলে কারন রিচমন্ড ফিরে আর যোগাযোগ হবেনা ওর সাথে তোমার |"

এরিক ভারীগলায় বলল, "একেবারে ঠিক বলেছো মিলেডি !"

"আমাকে করতেই হত তোমাদের জন্য এটা | এখন বলো ও কি বলে তোমার ব্যাপারে ?"

"লিজ রাজি আমাকে গ্রহণ করতে |"

এরিক একটু চুপ থেকে বলল, "এলান তুমি হয়ত রাগ হয়েছো | কিন্তু আমি অনুরোধ করব তুমি ওকে বিশ্বাস করবে | এটা তুমিও জানো যে লিজ অন্যায় করতে পারেনা |"

আইলান কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, "এরিক এখন একটা পরামর্শই দেব তোমাদের |"

"বলো |"

"আমাদের পারিবারিক নিয়মে আমরা সাধারনত অভিভাবক বিয়োগের অন্তত চল্লিশদিনের মধ্যে বিয়ের আয়োজন করতে পারব না | তুমি আর পনেরোদিন পর ওকে বিয়ে করে ফেলো | এরিক আমার বোন আমাকে না বললেও আমি জানতাম যে ও সমস্যায় আছে আর ডক্টরের সাথে ওর বিয়ে নিয়ে ও জটিলতায় আছে | এরিক দেরি করবেনা প্লিজ | ওকে জীবনে পেলে তুমি জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদটা পাবে |"

এরিক কোনরকমে নিজের আবেগ সামলে বলল, "অনেক ধন্যবাদ এলান | অনেক কৃতজ্ঞ আমি তোমার কাছে |"

"তোমার লিজ তোমারই ছিল | এখন দুজনেই জানলে সেটা |"

এরিক পরদিন আলিজাকে নিয়ে তার এটর্নির কাছে গেল | এরিক তাকে ড. মারলেইয়ের চেকটা ফিরিয়ে দিতে বলল কারন এরিক মি. হলসকে আলিজার এটর্নি রাখবেনা |

এরিক এতদিন পর তার বাবা রজারের সঙ্গে যোগাযোগ করল কারন তার লোকপরিচিতি উল্লেখযোগ্য রকমের ভালো | এরিক রজারের সহায়তায় ওয়াল্টার স্মিথ নামের একজন দক্ষ আফ্রিকান আমেরিকান সামরিক সলিসিটারকে আলিজার এটর্নি নিযুক্ত করল | তাকে সার্বিয়ায় যেতেই হবে একবার যদি সে আগামীমাসে একমাসের জন্য ছুটি নেয় তো | এজন্যই এরিক আলিজাকে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচিত করে বোন নিনার কাছে রেখে তার কাজে গেল |

এরিক গেল এবং বারোদিন পর ফিরে আলিজাকে ইউএসএ-এর সিভিল ম্যারিজ এক্ট এর নিয়মানুযায়ী স্টেটজাজের কাছ থেকে ম্যারিজ লাইসেন্স সংগ্রহ করে দুইধর্মের মিনিস্টার-এর ( ধর্মযাজক ) উপস্থিতিতে ম্যারিজ কমিশনারের কার্যালয়ে বিয়ে করল |

পোর্টার আগে থেকেই আলিজাকে চিনত আর সে এরিকের সব ভাইবোনকেই বলেছিল আলিজার কথা | সবাই তাকে সাদরে গ্রহণ করল | সবাই তাদের বিয়ের পর একটা পারিবারিক ভোজন আয়োজন করল সবাই উপস্থিত থেকে এমনকি সন্তানদের থেকে দূরে থাকা এরিকের মা জেনিন ও এলো তার বর্তমান বন্ধুকে নিয়ে |

এরিকের বিয়েতে সবচেয়ে আনন্দিত হল রজার | কারন এই একটা মেয়ে তাদের পরিবারে আসার পর সব বিচ্ছিন্ন সদস্যরা আবার একত্রিত হল | আলিজা তাদের বাপছেলের লড়াইয়ের অবসান করল |

রজার এই উপকারের জন্য এরিককে বলল, "তুমি কোন চিন্তা করবেনা | আমি জেনেশুনেই কেসটা স্মিথকে দিয়েছি | ও ফেডারেল প্রসিকিউটরদের ছাল তুলে নেয় | দেখে নিও তুমি | ওকে কেউ কোন অপবাদ দিতে পারবেনা | এটা এই চমৎকার মেয়েটার পাওনা এই বাবার কাছে |"

রজার তার কথা রেখেছিল সত্যিই |

বিয়ের পর স্বামী হিসেবে এরিকের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চেহারা আলিজা দেখল | যত্নশীল, প্রেমময়, রক্ষনশীল, সচেতন, সহানুভতিশীল একজন মানুষ | যে একইসাথে হাসিখুশি বন্ধুত্বপূর্ণ আবার একজন স্বামীর স্থানে আলিজার সবকিছুতে অধিকারসূচক |

আইলান এরিককে এইরূপে দেখে বারবার এককথাই বলত, "বানি তোকে বাবা, মা বা আমি কেউই তো সেভাবে অভিভাবক হিসেবে যত্নখেয়াল করিনি এজন্যই আল্লাহ্পাক আমাদেরকে শাস্তি দিয়ে দেখিয়ে দেবার জন্যই ওকে তোর জীবনে পাঠিয়েছে যে তোকে আজীবন আগলে রাখবে |"

সত্যিই তাই হয়েছে ! আলিজার প্রতিটা প্রয়োজনকে সে নিজের প্রয়োজন করেছে | এরিক তাকে আর ফিরতে দেয়নি ডরমিটরিতে | স্ত্রীকে ছেড়ে থাকতে সে রাজি নয় | এটর্নির সঙ্গে আলিজার প্রতিটা সেশনে এরিক তার হাতধরে পাশে বসে থাকত | সে আগেরমতোই আলিজার সাথে বন্ধুসুলভ ঘুরেবেড়ানো অব্যাহত রাখল কিন্তু একজন স্বামীর মত সে স্ত্রীর সবসময়কার খোঁজখবর নিজের আয়ত্তে রাখত | আলিজার তাকে না জানিয়ে কোথাও যাওয়াটা সে পছন্দ করে না | আলিজার স্বভাবে অবাধ্যতা আর উগ্রতা নেই বরং সে এরিকের প্রতি নিবেদিত ও প্রেমনিষ্ঠ যা এরিককে আরো আসক্ত করল তার প্রতি |

ডক্টর মারলেই কিন্তু সত্যিই আর যোগাযোগ করেননি আলিজার সাথে | এমনকি আলিজা তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পায়নি |

ট্রায়ালের দিন এরিক আলিজার হাতটা ধরে বলেছিল, "সুইটহার্ট ! কোন ভয় নেই তোমার | যা ছিল তা তোমাকে বদনাম করার জন্য একেবারেই যথেষ্ট না | ওরা কিছুই করতে পারবেনা | আমি আছি তোমার পাশে |"

ট্রায়ালের দিন ডক্টর মারলেই স্পেশাল কোর্টরুমে এলেন নির্দিষ্ট সময়ে | তিনি আলিজাকে দেখে সম্পূর্ণই অচেনা ব্যবহার করলেন | কিন্তু দ্রুতই তার কপাল কুঞ্চিত হল যখন ফর্মাল স্যুট পড়নে এরিককে আলিজার পাশে এসে বসতে দেখলেন | কিন্তু তিনি তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে স্থির অবিচলভাবে বসে রইলেন | ডক্টর চমকালেন তখন যখন ট্রায়ালে ইন্টারোগেশন-এর জন্য আলিজাকে ডাকা হল |

প্রসিকিউটরের প্রথম প্রশ্ন ছিল, "আপনার নাম বলুন |"

আলিজা এরিকের দিকে তাকাল, এরিক তাকে দেখে আশ্বাস্বের হাসি দিয়ে চালিয়ে যেতে ইশারা করল |

আলিজা ধীরস্থির শান্তস্বরে বলল, "মিসেস আলিজাহ আহমেদ ড্যানিয়েলস |"

মুহূর্তেই ডক্টর বিস্মিতচোখে তাকালেন | না, ভুল শোনেননি তিনি |

আর প্রসিকিউটরও হতবাক হল কিছুটা কারন তার জানামতে সন্দেহভাজন অভিযুক্ত হলেন অবিবাহিতা !

তিনি তাও প্রশ্ন করলেন, "আপনি বিবাহিতা ?"

আলিজা উত্তর করল, "জ্বি |"

"আপনার স্বামীর নাম ?"

"এরিক রজার ড্যানিয়েলস |"

"আপনি বিবাহিতা হয়েও কেন একজন পরপুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারী সম্পর্ক রাখলেন ?"

তৎক্ষণাৎ ডিফেন্স থেকে অবজেকশন এলো আর জাজ কর্তৃক তা সাস্টেইন্ড হল | প্রথম ধাপেই হোঁচট খেল প্রসিকিউটর |

এবার ডিফেন্স বলে উঠল, "যদি প্রসিকিউটর এর জোর প্রমান না দিতে পারেন তো এরজন্য তার বিরুদ্ধে তার মক্কেল মানহানির অভিযোগ আনবেন | তিনি প্রমান ভিন্ন একজন স্ত্রীলোকের উপর ব্যাভিচারের অভিযোগ আনতে পারেননা | সেটা মানহানিকর, স্ত্রীবিদ্বেষী ও মানবতাবিরোধী |"

এরপর অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ এলো, এমনকি ড. ওয়াইজম্যানও এলেন একজন সাক্ষী হিসেবে | কিন্তু কিছুই প্রমান হলোনা যে ডক্টর স্ত্রীর সাথে সেপারেশন অবস্থায় তার ছাত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রেখেছিলেন |

ইতিমধ্যে ড. স্কটের সাক্ষী এলো যে ড. মারলেই একবার আলিজাকে কাজে ভুল হওয়ায় ল্যাব থেকে বের করে দেন | এতে ডিফেন্সের অবস্থান শক্ত হল কেননা প্রণয়িনীকে নিশ্চই কেউ সবার সামনে অপমান করবে না !

এরিক তার সাক্ষ্যে জানালো তারা আগেই বিয়ে করত কিন্তু তার স্ত্রীর মাতৃবিয়োগের জন্য সেটা হয়নি | এতগুলো দিন এরিক আলিজার সাথেই ছিল তার দেশে | এর একাধিক এলেবাই পাওয়া গেল এবং তাদের প্লেনের টিকিট উপস্থাপিত হল |

ডক্টর আলিজার মায়ের মৃত্যুর সময় সবজেনেও যেহেতু সেখানে থাকেননি তাই এবারও সব একিউজেসন বাতিল হল |

এবার ডিফেন্স মোটামুটি ধোলাই করে ফেলল ডক্টরের প্রাক্তন স্ত্রীকে | ডিফেন্স এটা প্রমান করলো যে প্রিন্যাপ-এর অতিরিক্ত এলিমোনি আদায়ের জন্যই মিস ট্রিশিয়া ল্যান্ড আলিজাকে অমূলক সন্দেহভাজন করে একাজটা করেছেন | কোর্টকে তা মানতে হল কেননা আলিজার জিনিসপত্রের ফরেনসিক রিপোর্ট আর তার মেডিক্যাল রিপোর্টও এর প্রমান দিলো যে অহেতুক একজন সচ্চরিত্রা স্ত্রীলোকের উপর অমূলক আক্রমন এসেছে |

অভিযোগ বাতিল হল মাসখানেকের মধ্যেই |

শেষের দিন ফলাফলের পরপরই আলিজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেঁদে ফেলল |

এরিক তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, "লিজ ! লিজ ! প্লিজ সুইহার্ট কান্না বন্ধ করো | সব শেষ হয়েছে | আর কোন টানাপোড়ন কোন ভয় কিছুই নেই |"

ড. মারলেই দাঁড়িয়ে দুজনকে দেখে চলে গেলেন | কিন্তু একদিন পর তিনি তার উকিলকে পাঠালেন সবকিছু ঠিক আছে কিনা জানতে চেয়ে | এর কারন হল ডক্টর ভেবেছিলেন বিয়ের ব্যাপারটা সাজানো | ডক্টর তার নিরাপত্তা আর সম্মানের স্বার্থে আসতে পারছেন না তা আলিজা নিশ্চই জানে |

এতদিন যা হয়েছে তা নিয়ে আহত না হলেও এবার আলিজা আহত হল | কারন ড. মারলেই ভেবেছেন যে আলিজা যেহেতু ডক্টরের নিয়োজিত এটর্নির কাছে যায়নি তাই সে হয়ত নিজেই কোন উপায় বেছেছে | ড. ভেবেছেন যে আলিজা আর এরিকের বিয়েটা নকল !

এরিক রেগে ক্রুদ্ধ হয়ে গেল | আলিজা তাকে বহুকষ্টে থামিয়ে রাখল |

এবার রজার কথা বলল | সে ডক্টরের উকিলকে বলল, "যে মুহূর্তটায় একজন মেয়ের তার সাথীটিকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল তখন তোমার বিজ্ঞ মক্কেল তাকে একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল নিজের জীবন থেকে | কেননা সে তার সম্মানের সাথে সমঝোতা করবেনা ! তার সঙ্গে একবার দেখা করা তো দূরের কথা, ঠিকমত কথা বলার সময়টুকুও রাখেননি | ব্যাপারটা তার আর তার লোভী স্ত্রীর মধ্যে অথচ এখানে অগ্নিপরীক্ষাটা একটা নিরীহ মেয়ের | যাক ! তোমার মক্কেলকে বলবে যে সে নিশ্চিত থাকতে পারে নিজের খ্যাতি আর সম্মান নিয়ে | তাকে আর আমার পুত্রবধূর কথা ভাবতে হবে না | ওর জন্য আমার ছেলে আছে, আমি আছি আর আমার সম্পূর্ণ পরিবার আছে |"

ডক্টর যা অবিশ্বাস করলেন পরে এর সত্যতা জানলেন | জানলেন যে আলিজা সত্যিই এরিককে বিয়ে করে ডরমেটরি ছেড়ে এরিকের বাড়িতে চলে গিয়েছে | এখন তারা সেখানেই থাকে |

আলিজা তার কাজকর্ম ছেড়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু তার স্বামী আর ড. ওয়াইজম্যান সেটা করতে দেয়নি আলিজাকে | সে আলিজাকে তার রিসার্চ চালিয়ে যেতে বলছে | আলিজা যদি ড. মারলেইয়ের কাছে আর কাজ করতে না চায় তো সে শুধু ড. ওয়াইজম্যানের সুপারভাইজিং-এ থাকুক |

আলিজা কাজের চেষ্টা করেছিল কিন্তু এরিক দেয়নি | এরিক চায় সে তার রিসার্চ শেষ করুক | এরিকের যা আয় তা দুজনের স্বচ্ছল জীবনের জন্য অনেক | তা ছাড়াও সে আলিজার কোন দায়িত্ব নিতে পিছপা নয় |

একদিন আলিজাকে ডেকে পাঠালেন ড. মারলেই | আলিজা সহজ স্বাভাবিকভাবে তার সামনে গেল | ট্রায়ালকালীন সময় ডক্টর যেমনটা করতেন আলিজাও ঠিক সেই ব্যবহারটাই করল | একদম সৌজন্য আর পোশাকি |

ড. মারলেই বিনা ভণিতায় বললেন, "মিস এহমেড তুমি নাকি আমার কাছে রিসার্চ করতে আগ্রহী নয় কথাটা কি সত্য ?"

আলিজা জবাব দিল, "ডক্টর শুধু আপনার কাছে নয় তা নয়, আমি এসব ছেড়ে দিতে চাই |"

"তোমাকে তো বুদ্ধিমান বলেই মনে হয় | এই সিদ্ধান্ত কেন তবে ?"

"হয়ত আমি বুদ্ধিমান নই |"

"মিস এহমেড যা হয়েছে তা হওয়াটা দুঃখজনক | কিন্তু এরকম কিছু করোনা |"

"ডক্টর আমি এরই মধ্যে আমার এইডের প্রায় একতৃতীয়াংশ শোধ করে দিয়েছি | আমি আর এর সঙ্গে থাকব না |"

ড. মারলেই বেশ নরম হয়ে বললেন, "মিস এহমেড তুমি আমার উপর খুব অভিমান করেছো আমি জানি সেটা |"

আলিজা একটু হেসে বলল, "না ডক্টর আমি কোনরকম কোন অভিমান করিনি | বরং আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি | আপনি যদি আমাকে ওই দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে না ফেলতেন তো আমি আমার মনকে হয়ত সত্যিকার অর্থে বুঝতাম না |"

"আমার ধারণা তুমি এখনও নিজের মনকে বুঝছনা |"

"না ডক্টর | আমি এখনই প্রকৃত অর্থে নিজের মনকে বুঝেছি |"

"মিস এহমেড তুমি কি ড্যানিয়েলসকে সত্যি স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছো ?"

"হ্যা ডক্টর | এরিক আমার স্বামী আর আমি আমার স্বামীকে প্রচন্ড ভালোবাসি |"

"তার সম্পর্কে সব জেনেও ?"

"এরিক কখনোই কিছুই লুকায়নি তো আমাকে ! আমি প্রথমথেকেই ওর সবই জানতাম | ডক্টর আপনি সেদিন বলার অনেক আগেই আমি জানতাম যে ও একজন এএফএসসি এজেন্ট অফিসার | ও আগেই আমাকে বলেছিল যে ও একজন প্রাক্তন ইউএসএএফ অফিসার | একদিন ও খুব অসুস্থ ছিল সেদিন আমার ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল | ও সম্ভবত কোন মিশন থেকে বেশ আহত হয়ে ফিরেছিল | ও রাস্তায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল, আমি সোয়ান থেকে বেরিয়ে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে ওর দেখা পাই | ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে ওর নোংরা পোশাক পাল্টাতে গিয়ে আমি ওর পায়ে একটা মিলিটারি গ্রেড ছুরি পাই আর ওর পিঠের বাঁপাশে একটা উল্কি যা দেখে আমি অনেকটা নিশ্চিত হই যে ও ইন্টেলিজেন্সির সাথে জড়িত | তাছাড়া ওর গায়ে যে আঘাতগুলো লেগেছিল সেটা কমব্যাট উন্ড | তো ডক্টর আমি সবই জানতাম প্রথম থেকেই | আমি জানতাম না আপনাকে | আমি জানতামনা যে আপনার স্ত্রীর সাথে তখনও আপনার ছাড়াছাড়ি হয়নি বরং আপনি ডিভোর্স ফাইল করেছেন কেবল | আর আপনার স্ত্রী আমাকে জড়িয়েছেন আপনাকে জব্দ করতে তাও আমি কিছুই জানতাম না | আপনি তার কাছে হার মানবেন না তাই আপনি আমাকেও বাজিতে লাগিয়ে দিলেন | যেদিন আমি আমাকে কিসের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে আমি প্রথম জানলাম আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম | আপনি প্রথম থেকেই এর সবটা জেনেও নির্বিকার ছিলেন | কারন আপনি শধুমাত্র একজনকেই ভালোবাসতে পারবেন আজীবন | তা হল আপনার খ্যাতি, প্রতিপত্তি আর সম্মানকে | এরিক আপনার মত অসাধারন কেউ নয় কিন্তু এরিক সাধারণ মানুষও নয় | সেটা আপনিও জানেন | ড. আপনাকে অনেকেই চায় | কিন্তু আপনি কাউকেই চাননা |"

"মিস এহমেড তুমি সত্যিই ড্যানিয়েলসকে চাও ?"

আলিজা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, " ডক্টর আপনি একবার একটা কথা বলেছিলেন আমাকে | তা হল, 'জীবনে খুব কম এমন মুহূর্ত আসবে যখন আমাদের চেতনা, মন আর দেহ এই তিনটা বস্তু একত্রে একই সিদ্ধান্ত দেবে | এমন কোন মুহূর্ত যদি আসে সেই মুহূর্তে উচিত সম্পূর্ণ পৃথিবীর বিপক্ষে গিয়ে হলেও সেই সিদ্ধান্তটা নেয়া | এতে কে কি ভাবল, কার কি প্রতিক্রিয়া হল, কার মনে আঘাত লাগল এসব কোন চিন্তা করা যাবে না | শুধু সেই সিধান্তটাকে আঁকড়ে ধরতে হয় |' আমার জীবনে ডক্টর সেই মুহূর্তটা সেদিন এসেছিল যেদিন আপনি আমাকে নিজের কাছথেকে আলাদা করে দিলেন আপনার প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে যুদ্ধে নেমে |"

আলিজা উঠে দাঁড়াল | বেরিয়ে যাবার আগে বলল, "ডক্টর আমি কিন্তু সত্যিই আপনাকে খুবই পছন্দ করতাম | একজন চমৎকার মানুষ হিসেবে জেনেছিলাম আপনাকে | হয়ত ভালোবাসতেও শিখে যেতাম | আর সেজন্যই আপনি যখন আমার হাতটা ছেড়েদিলেন তখন এতটা আঘাত পাই আমি আর সঠিকবেঠিক একমুহূর্তে জেনে যাই | এরিক একজন 'পারফেক্ট' মানুষ নয়, কিন্তু ও কোনদিনই আমার হাত ছেড়ে দেয়নি | সত্যিকার ভালোবাসাটা ব্যক্তিত্ব আর অভিজাত্য নির্ভর নয় | সেটা নির্ভর করে প্রেম, নৈকট্য আর পারস্পরিক আকর্ষণের উপর | আসি ডক্টর | ভালো থেকেন |"

একদিন আলিজা এরিকের সাথে গ্রোসারি শপিংয়ে গিয়েছে | এরিক বাথরুমে গিয়েছে তখন হঠাৎ ড. মারলেইয়ের প্রাক্তন স্ত্রী তার সামনে এলো |

ট্রিশিয়া হন্তদন্তভাবে বলল, "আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি | আমি অন্যায় করেছি তোমার সঙ্গে | আমাকে ক্ষমা করে দাও |"

আলিজা বিস্মিত হয়ে বলল, "মিস ল্যান্ড আপনি যাই করেছিলেন না কেন তখন আমি সেইসব থেকে অনেক দূরে এগিয়ে এসেছি | আপনার সঙ্গে আমার আর কোন শত্রুতা বা রেষ কোন সম্পর্ক নেই | অনুগ্রহ করে পথ ছাড়ুন |"

ট্রিশিয়া মরিয়া হয়ে এলিজার ট্রলি আগলে বলল, "প্লিজ মিস এমেড ! তোমাকে আমার কথা শুনতেই হবে ! আমি খুব বিপদে আছি | তুমি আমার সঙ্গে চল |"

"ইটস মিসেস ড্যানিয়েলস নাও ( আমি এখন মিসেস ড্যানিয়েলস ) | আপনি সম্পূর্ণ নিজের স্বার্থ আদায়ে আমাকে যে বিপদে ফেলেছিলেন এর পরেও আমি আপনাকে বিশ্বাস করব তা আপনি ভাবলেন কিকরে ?"

"প্লিজ মিসেস ড্যানিয়েলস চলো আমার সঙ্গে ! তুমি শুধু গ্লেনকে একবার বলে দাও যে আমাকে তুমি ক্ষমা করেছো | ও খুব সাংঘাতিক ! আমি মানি আমি ভুল করেছি | কিন্তু ও আমাকে শেষ করে দেবে | প্লিজ আমাকে সাহায্য করো |"

তখনই এরিক দ্রুত এগিয়ে এসে আলিজাকে আড়ালকরে দাঁড়িয়ে বলল, "মিস ল্যান্ড সরে যান দোয়া করে ! আপনি যদি এখনই না যান তো আমি মল সিকিউরিটিকে ডাকবো | প্লিজ চলে যান |"

ট্রিশিয়া বলল, "তুমি নিশ্চই ওর স্বামী | আমি তোমাকেও বলছি | আমি ক্ষমাপ্রার্থী যা হয়েছে সেজন্য | আমাকে সাহায্য করো |"

এরিক আলিজাকে আগলে দাঁড়িয়ে বলল, "মিস ল্যান্ড তোমার মত অর্থলিপ্সু মানুষের সঙ্গে এই হওয়া উচিত | তুমি অবৈধভাবে অর্থ আদায় করতে গিয়ে আমার স্ত্রীকে কাঠগড়ায় তুলেছিলে এটা জেনেও যে সে নির্দোষ | তোমার শাস্তি হয়ে উচিত | কারন তুমি কুকুরের ল্যাজ ! তোমাকে ক্ষমা করলে তুমি আবার আগের চেহারায় ফিরে থাবা বসাবে |আর এইযে তোমার চোখের পানি এ হলো কুমিরের কান্না ! এতে আমাকে অন্তত ভোলাতে পারবেনা তুমি !"

ট্রিশিয়া আরো জোরাজুরি করলে এরিক মল সিকিউরিটিকে ডেকে তাকে সরালো |

আলিজা পরে মি. স্মিথের কাছে জন্য যে ড. মারলেই তার স্ত্রীর নামে মানহানি, পেপারফ্রড ( কাগজপত্র জালিয়াতি ) আর ম্যারিটাল ইলিজিমেসি ( বিবাহ বহির্ভুত অনৈতিক সম্পর্ক ) অভিযোগ করেছেন | ইলিজিমেসি অভিযোগ করেছেন মিস ল্যান্ডের প্রসিকিউটর শন হার্পারের নামে | হার্পার ড. মারলেইয়ের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন তাই সেই সুবাদেই ট্রিশিয়া আর হার্পার ঘনিষ্ঠ হয় | ড. মারলেই এর সবই জানতেন কিন্তু তিনি যেহেতু স্ত্রীকে ডিভোর্স দিচ্ছেন তাই এসব ঘাঁটাননি ! কিন্তু কিছুদিন আগে তিনি কেস ফাইল করলে ট্রিশিয়া যখন অত্যাশ্চর্য হয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে তখন তিনি এর কারন জানান ট্রিশিয়াকে |

ডক্টর তার প্রাক্তন স্ত্রীকে বলেন, "তোমার জন্য আমি একটা অপূরণীয়, অপ্রতিস্থাপনীয় সম্পদকে হারিয়েছি ! তোমার হিংসা আর লালসার জন্য আমি মিস এহমেডকে, আমার জীবনে আসা সবচেয়ে চমৎকার স্ত্রীলোকটিকে হারিয়েছি | তুমি তোমার লালসা পূরণে আমাকে এমন প্রতিযোগিতায় নামিয়েছিলে যে আমি নিজেকেও ভুলে গিয়েছিলাম আর তার মত একজন মানুষকে কষ্ট দিয়েছি | তোমার কোন ক্ষমা নেই | আমি তোমাকে আর তোমার প্রসিকিউটর বন্ধুকে শেষ করে ছাড়ব |"

প্রতিটা অভিযোগ প্রমান হয়ে ট্রিশিয়া ল্যান্ড আর শন হার্পার সর্বশ্রান্ত | হার্পার তার ওকালতির লাইসেন্স হারিয়েছে মিস ল্যান্ডকে নকল কাগজ তৈরির মত অপরাধে সহায়তায় | আর ট্রিশিয়ার ১৬ বছরের প্রিজনমেন্ট সেন্টেন্স হয়েছে | সব মিটে যাবার পর ড. মারলেই একদিন আলিজার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান | আলিজা এরিককে জানালে সে সম্মতি দেয় |

ড. মারলেই আলিজাকে দেখে বললেন, "সত্যিকারের প্রেম তাহলে সত্যিই খুঁজে পেয়েছো তুমি |"

আলিজা হাসল |

ডক্টর বললেন, "মিস এহমেড আমি চাই তুমি তোমার গবেষণা চালিয়ে যাও | আমার তোমার সুপারভাইজার থাকতে কোনরকম কোন আপত্তি নেই |"

"আমি আর কাজ এগুতে চাইনা |"

"মিস এহমেড আমার নিজের কৃতকর্মের জন্য অনেকবড় শাস্তি আমি পেয়েছি | এরপর তুমি যদি এখন আবার নিজের কাজ বন্ধ করে দাও তো আমি নিজেকে ক্ষমা করার শেষ সুযোগটাও হারাবো |"

"ডক্টর আপনি বুঝতে পারছেন হয়ত যে ব্যাপারটা বেশ কষ্টকর আমার জন্য |"

"মিস এহমেড আমার ব্যবহার তোমাকে খুব আহত করেছে আমি জানি | সত্যিটা হল ট্রিশিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আমি ওর মতই একজন স্বার্থপর মানুষ হয়ে পড়েছিলাম নিজের সুবিধা চিন্তা করে | আমার এই অপরাধ ক্ষমা করা কষ্টকর তোমার পক্ষে | কিন্তু তাও একান্ত অনুরোধ রইল আমার, তুমি কাজে ফেরো আবার | আমার সঙ্গে কাজ করতে না চাইলে আমার আপত্তি নেই | তুমি হ্যাঙ্কের সাথে কাজ করো | আর ড. স্কটও তোমাকে সাহায্য করবেন | আমাকে একটা সুযোগ দাও |"

"ডক্টর আমি আগেই বলেছি আমার কোন অভিমান অভিযোগ নেই আপনার প্রতি | নিজেকে আর দোষারোপ করবেন না | আপনি একজন চমৎকার মানুষ ডক্টর | আমি প্রার্থনা করি আপনি সুখী হন | ঠিক আছে | আমি আপনার অনুরোধ রক্ষা করলাম | আমি কাজে ফিরব | আপনি চাইলে আমার গবেষণার তত্বাবধাণ করবেন | "

ড. মারলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "আমার অহংকার আমাকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা প্রকাশের ভাষা আমার নেই | মিস এহমেড আমার শুভকামনা রইল তোমার প্রতি | কখনও কোন প্রয়োজন হলে তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবে |"

আলিজা হাসল একটু |

ফেরার সময় ড. মারলেই এরিককে বললেন, "তোমাকে আমি ভুল বুঝেছিলাম সেজন্য দুঃখিত |"

এরিক বলল, "ডক্টর একটা কথা কি জানো ? লিজ কিন্তু তোমাকে বেশ পছন্দ করত | ওকে বিয়ে করলে তুমি একটা অসাধারন স্ত্রী পেতে | কারন ওর অসম্ভব রকমের আপন করার ক্ষমতা রয়েছে যা ঐশ্বরিক দান বলতে পারো |"

"বুঝতে পারছি তোমাকে দেখে সেটা |"

"ডক্টর একটা জিনিস ওকে পেয়ে জীবনে জানলাম তা হল খুব আগ্রহের বস্তুকে মন থেকে চাইলে সত্যিই পাওয়া যায় তবে একটা শর্ত আছে এর | তুমি তাকে অবহেলা করতে পারবেনা | অবহেলায় অনেক কাঙ্খিত জিনিসও হাতের মুঠোয় থেকেও নষ্ট হয় | তবে তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি | তুমি ওকে আঘাত না করলে ওকে পেতাম না আমি |"

বিয়ের মাস নয়েক পর একদিন এরিকের মেয়ে ম্যাডিসন ফোন করল ঘরে | এরিক তখন দেশে নেই আর রজার কি যেন দরকারে এক প্রতিবেশীর কাছে গিয়েছে |

আলিজা ফোন ধরতেই সে বলল, "তুমি কি আমার বাবার মতুন স্ত্রী ? প্লিজ আমার বাবা এরিককে ডেকে দাও |"

আলিজা সুন্দরকরে বলল, "ম্যাডিসন আমার নাম আলিজা | আমি চিনি তোমাকে | তোমার সাথে দেখাও হয়েছে | কেমন আছো তুমি ?"

ম্যাডিসন অস্থিরভাবে বলল, "প্লিজ আমার ড্যাডিকে ডেকে দাও | আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিনা |"

আলিজা ম্যাডিসনের কথাতেই বুঝল কিছু নিয়ে সে খুব বিচলিত, কেননা আলিজা দেখেছে মেয়েটিকে | শান্তশিষ্ট চুপচাপ |

আলিজা বলল, "ম্যাডিসন তোমার ড্যাডি ঘরে নেই | আমাকে বলো কি হয়েছে |"

ম্যাডিসন চিৎকার করে বলল, "না তুমি মিথ্যা বলছো ! তোমরা কেউই আমাকে আমার ড্যাডির সঙ্গে কথা বলতে দিতে চাও না | ড্যাডিকে ডাকো ! আমি কথা বলবো !"

আলিজা সান্তনা দিয়ে বলল, "ম্যাডিসন আমি কোনদিনই এমন কিছু করবো না | তুমি যখন ইচ্ছা তোমার ড্যাডির সঙ্গে কথা বলবে | তোমার ড্যাডি সত্যিই ঘরে নেই | তুমি আমার সঙ্গে কথা না বলতে চাইলে তোমার গ্র্যান্ড-ফাদারের সঙ্গে কথা বলো | উনিও এখানে রয়েছেন |"

ম্যাডিসন চুপ করে রয়েছে | সে একটু পর কেঁদে ফেলে বলল, "এলসা তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে ?"

"অবশ্যই ! আমি যা পারি তোমার জন্য করবো !"

তখন একটা অপরিচিত মহিলা ফোনটা হাতে নিয়ে কথা বলল, "মিসেস ড্যানিয়েলস ?"

"হ্যা বলছি | এইমাত্র যে মেয়েটি কথা বলল সে কোথায় এখন ? সে আমার স্বামীর কন্যা | আপনি কে বলছেন ?"

"আমার নাম রোজ জেনার | আমি এলএ ( লস এঞ্জেলেস ) থেকে বলছি | এই মেয়েটি কিছুক্ষন আগে আমার গাড়ির জানালার সামনে এসে পড়ে | সে তার বাবার কাছে যেতে চাইছে | আমি তাকে নিয়ে পুলিশস্টেশনে যেতাম কিন্তু সে কান্না জুড়ল বলল যে পুলিশ তাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে | সে সেখানে যেতে চায়না ফিরে |"

আলিজা বুঝল ঝামেলা বেশ বড় | তাই সে মহিলাকে বলল মেয়েটিকে পুলিশস্টেশনে চাইল্ডকেয়ার কাস্টডিতে দিতে | আলিজা মহিলার নম্বর আর পুলিশস্টেশনের ডিটেইলস সব টুকে ফোন রেখে দিল | সে আর মুহূর্ত দেরি না করে রজারকে ডেকে এনে সব বলে লস এঞ্জেলেস রওনা হল |

আলিজা এএ-এর অফিসে ফোন করে এরিককে যত শীঘ্রই সম্ভব লস এঞ্জেলেসে চলে আসতে বলল |

রজার নিউপোর্টের চাইল্ড কাস্টডিতে খোঁজ করে ম্যাডিসনের খোঁজ নিয়ে আলিজাকে নিয়ে ম্যাডিসনকে আনতে গেল | আলিজা দেখল ম্যাডিসন ঘরের পোশাক একটা সাদা স্লিভলেস টপ আর ট্রাই-কোয়ার্টার গোলাপি টাইটস আর কিটি স্লিপার্স চপল পড়নে, কেঁদে কেঁদে চেহারা বিধস্ত আর মাথার সোনালী পাটকিলে চুলগুলো অগোছালো এলোমেলো |

রজারকে দেখেই এরিকের প্রাক্তন স্ত্রী মেলিসা রীতিমত ঝগড়া শুরু করল | তারা অভিযোগ করল যে এরিক আর তার বাবা রজার ম্যাডিসনকে ভুলিয়েভালিয়ে তার মন ঘুরানোর চেষ্টা করছে |

আলিজা এসব ঝগড়া তর্কের কিছুতেই রইল না | সে ম্যাডিসনের কাছে গিয়ে বসল | ম্যাডিসন খুব ভয় পেয়েছে কিছু নিয়ে |

আলিজা তার মাথায় হাতবুলিয়ে শান্ত করে কাছে টেনে নিয়ে বলল, "ভয় পেও না | তোমার ড্যাড চলে আসবে কালই | সব ঠিক হয়ে যাবে |"

জ্বরে আর আতংকে কাঁপতে থাকা ম্যাডিসনকে নিজের শালের ভেতর টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বসল আলিজা |

আলিজার গায়ে মাথা রেখে ম্যাডিসন কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, "এই এম ডার্টি এন্ড মেসড নাও | ইউল গেট ডার্টস অন ইউ | ( আমি ময়লা আর নোংরা মেখে আছি | তোমার গায়ে নোংরা লেগে যাবে |) "

আলিজা তার মাথায় চুমু দিয়ে বলল, "না সোনা ! তুমি নোংরা নও | কিছু মানুষের মনটা নোংরা |"

"আম স্কেয়ার্ড ! ( আমার ভয় করছে ! )"

"কোন ভয় নেই যতক্ষণ আমি আছি |"

আলিজা ম্যাডিসনের গালের,হাতের, গলার আর পায়ের কালভসে লাগা চোটগুলো দেখেই অনেকটা আন্দাজ করে নিলো যে কি এমন সাংঘাতিক ঘটেছিল যা একটা আট বছরের শিশুকে ঘর থেকে পালানোর মত দুঃসাহসী কাজে বাধ্য করেছিল |

আলিজা মেডিক্যাল টেস্টিংয়ের সময় ম্যাডিসনের হাতধরে বসে রইল | যতবার সে কাঁদল আলিজাও নিজের চোখমুছে তাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিল |

রজার পোর্টার আর প্রেস্টনকে উকিলের কাছে রেখে এসে দেখল আলিজা মেডিক্যাল টিমের কাজ শেষ হবার পর ম্যাডিসনের চোখ মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে দিয়ে বলছে, "কে বলেছে তুমি নোংরা ! এরকম কথা যে বলেছে সে নিজেই নোংরা |"

আলিজা শাড়ির আঁচল দিয়ে ম্যাডিসনের মুখহাত মুছে দিয়ে মাথায় আঙ্গুল চালিয়ে তার চুলগুলো বেণী করে দিলো | এরপর তাকে পাশে বসিয়ে নিজের শালে জড়িয়ে নিয়ে বলল, "ঘুমাও এখন একটু তুমি সোনা ! কোন ভয় নেই | আমি আছি |"

রজার এসে সেখানে তাদের পাশে বসে দেখল আলিজাকে জড়িয়ে ধরে ম্যাডিসন ঘুমাচ্ছে |

রজার আলিজার মাথায় হাত রেখে বলল, "তুমি একদিনে ওর জন্য যা করলে ওর মা সারাজীবনে তা করেছে কিনা সন্দেহ ! সত্যিই আমার ছেলেটা এইদিকে দুর্ভাগা ছিল ! ওর মা ছিল উদাসীন সন্তানদের প্রতি আর ওর স্ত্রীও সেরকম ছিল | যাক ! আর চিন্তা নেই | এখন তুমি আছো ওর জীবনে |"

প্রেস্টন এসে বসল বাপের পাশে | সে একবার মাথা উঁচু করে দেখে বলল, "তো ঘুমাচ্ছে ম্যাডি ! ওর ঘুম দরকার | মেলিসা চিৎকার করে দুনিয়া ফাটিয়ে ফেলছে | এলসা ?"

"বলো প্রেস্টন |"

"তাহলে তুমি যা সন্দেহ করেছিলে তাই ?"

আলিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে | হ্যা, তাই |"

"আমি ভাবছি এরিক এলে কি অবস্থাটা হবে ! ওতো মেরে আধামরা করে ফেলবে ওই জিউইশ শিটব্যাগটাকে !"

"না সেটা করা ঠিক নয় |"

"হুম তাই তো বলছি | কিন্তু ওকে বোঝাবে কে !"

"আমি বলবো | বলবো যে পিটিয়ে ওকে খুন করা উচিত |"

প্রেস্টন বিস্মিত হয়ে তাকালো |

আলিজা বলল, "এ ধরনের মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই কোন |"

এরিক এলো পরদিন দুপুরে | সে প্রায় দৌড়ে ভেতরে এসে দেখল চাইল্ড কাস্টডিতে আলিজা বসে রয়েছে ম্যাডিসনকে ধরে |

আলিজা এরিককে দেখে ধীরে ধীরে ম্যাডিসনকে ডেকে বলল, "ম্যাডি ! সোনা দ্যাখো ড্যাডি এসেছে !"

ম্যাডিসন চোখমেলে এরিককে দেখে তীর বেগে "ড্যাডি ! ড্যাডি !" বলে ছুটে গিয়ে বাবার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল |

এরিক মেয়েকে দুহাতে কোলে তুলে নিয়ে বুকের মাঝে চেপে ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, "আমি এসে পড়েছি আমার লিটল কাপকেক ! আর কোন ভয় নেই |"

আলিজার চোখে পানি এসে গেল দুজনকে দেখে | এরিক একবার তাকিয়ে আলিজাকে হাতবাড়িয়ে কাছে আসতে ইশারা করল |

মেয়ে আর স্ত্রী দুজনকেই শক্তকরে জড়িয়ে ধরে এরিক জিজ্ঞাসা করল, "ব্যাপারটা কি সত্যি লিজ ?"

আলিজা কান্না আটকে বলল, "হ্যা |"

"অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে এমন একটা সময়ে ওকে সামলানোর জন্য | আমি পোর্টারের কাছে শুনলাম যে তুমি কিভাবে ওর সঙ্গে থেকেছো | আমি ঋণী তোমার কাছে |"

"ছি এরিক ! এটা আমার কর্তব্য ছিল আমার মেয়ের প্রতি যা আমি করেছি | এখন তুমি বাবার কর্তব্যটা করো |"

রাতে মেলিসা, তার বয়ফ্রেন্ড কেভিন আর কেভিনের ভাই কার্ল তাদের দোকানের দরজা বন্ধ করে দিনের হিসেবে মেলাচ্ছিল এমন সময় পাওয়ার কাট হল | মেলিসা উঠে মোম আনতে গেল তখনই এরিক দরজায় লাথি মেরে ভেতরে ঢুকে কার্লকে টেনে ধরে উড়িয়ে টেবিলের উপর ফেলে দিল |

মেলিসা তাকে ধরে থামাতে গেলে সে একটা দশাসই থাপ্পড় বসিয়ে বলল, "এই থাপ্পড়টা অনেক আগে মারা উচিত ছিল তোমাকে | তুমি দিনের পর দিন আমার মেয়ের ভরনপোষনের টাকা আদায় করেছো তাকে ব্যবহার করে ! গত এক সপ্তাহ যাবৎ এমন একটা ঘটনা, এমন জঘন্য একটা ব্যাপার ওর সঙ্গে হয়ে আসছে আর তুমি এরজন্য একটুও অনুতাপ করছো না ? মা তো দূরের কথা একটা মেয়েলোক বলারও যোগ্য না তুমি |"

কেভিন বলল, "তোমার মেয়ের কল্পনা এসব !"

এরিক একটা ঘুঁষি মেরে তার কয়েকটা দাঁত নড়িয়ে দিয়ে বলল, "আমার মেয়ের কল্পনা ? লজ্জা হয়না এসব বলতে !"

এরিক মোটামুটি রামধোলাই দিলো কার্লকে | তাকে বহুকষ্টে টেনে নিয়ে গেল রজার আর প্রেস্টন |

.......................................................

( চলবে )

Czytaj Dalej